'বীরত্ব' দেখাতে বেপরোয়া

চট্টগ্রাম শহরে তুচ্ছ ঘটনায় ‘বীরত্ব’ দেখাতে বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোরেরা। চুরি কিংবা ঘর পালানোর মতো অপরাধ পেছনে ফেলে ধর্ষণ, প্রকাশ্যে রাস্তায় গুলি করে হত্যা ও অপহরণে জড়িয়ে পড়ছে তারা। এসব কিশোরের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের সন্তান যেমন আছে, তেমনি আছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানও।

এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে এমন ১১টি অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে কিশোরেরা জড়িত। ১১টি মামলা এখন তদন্তাধীন রয়েছে। কয়েকজন কিশোর জামিনে রয়েছে।

চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বীরত্ব দেখাতে গিয়ে কিশোরদের মধ্যে খুন, ধর্ষণ, অপহরণে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ উদ্বিগ্ন। কিন্তু পুলিশের একার পক্ষে এটি রোধ করা সম্ভব নয়।

সাত বছর ধরে চট্টগ্রাম শহরে কাজ করেন এমন একজন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রথম আলোকে বলেন, আগে কিশোরেরা খুনোখুনিতে গেলেও হাতে অস্ত্র ছিল না। এখন তারা অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় মহড়া দিচ্ছে। এদের যারা অস্ত্র দিচ্ছে, তাদেরই আগে ধরা উচিত।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, পুলিশ বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালাচ্ছে। যেমন সন্ধ্যার পরে ঘরের বাইরে না থাকা, বাবা-মায়ের কথা শোনা, জঙ্গিবাদের হুমকি সম্পর্কে সচেতন থাকা ইত্যাদি।

গত ২৭ মে চট্টগ্রাম নগরের বন্দর থানার দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর এলাকায় রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা সজল নন্দীকে (৪৮) খুন করা হয়। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ছায়া তদন্ত করতে গিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। এদের একজন ১৬ বছর বয়সী নবম শ্রেণির ছাত্র। আরেকজন একই বয়সী এসএসসি পাস করেছে। তাদের ‘বড় ভাই’ ১৯ বছর বয়সী জয় বড়ুয়া চৌধুরী এবার এইচএসসি দিয়েছেন। গত ১ জুন এই তিনজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তারা বলে, সজল নন্দীর ছেলে নবম শ্রেণিপড়ুয়া কিশোর তাদের বন্ধু। ২৯ লাখ টাকা নেওয়ার জন্য তারা বন্ধুর বাবা সজল নন্দীকে গলা কেটে খুন করে।

এই তিন কিশোরের মা-বাবা চাকরিজীবী। কেউ পোশাক কারখানায়, কেউবা গাড়িচালক। এক কিশোরের গাড়িচালক বাবা প্রথম আলোকে বলেন, ব্যস্ততার কারণে ছেলের খবর নিতে পারতেন না। ছেলে এত বড় ভুল করবে, কল্পনাই করেননি। নিহত সজলের স্ত্রী রুমা দে বলেন, ছেলের বন্ধুরা তো ছেলের মতো। এ ধরনের ঘটনা আর যাতে না ঘটে, সেদিকে সবার নজর রাখা উচিত।

গত ২ মে এক সহপাঠী ছাত্রীর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় করা মামলায় নবম শ্রেণিপড়ুয়া এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই মামলায় মো. আসিফ নামের কলেজপড়ুয়া আরেক তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি ওই কিশোরের বড় ভাই। সানশাইন গ্রামার স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল মেয়েটি। গ্রেপ্তার কিশোর এলিমেন্টারি স্কুলের শিক্ষার্থী। নগরের পতেঙ্গা থানার নেভাল একাডেমি-সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীর তীর থেকে পুলিশ স্কুলছাত্রীটির লাশ উদ্ধার করে। তার বাবার দাবি, ‘গ্রেপ্তার হওয়া কিশোরই তাঁর মেয়েকে অন্য বন্ধুদের দিয়ে খুন করিয়েছে।’

গত ১৬ জানুয়ারি ক্রিকেট খেলা নিয়ে বিরোধের জেরে জামালখান মোড়ে ব্যস্ত সড়কে স্কুলছাত্র আদনান ইসফারকে খুন করে কয়েকজন কিশোর। ১৯ জানুয়ারি পাঁচ কিশোর আদালতে জবানবন্দি দেয়। তারা বলে, ঘটনার দিন তাদের হাতে পিস্তল থাকায় ভয়ে সামনে কেউ আসেনি। এনাম হোসেন নামের ছাত্রলীগের এক নেতা তাদের অস্ত্রটি দিয়েছিলেন। পাঁচ কিশোরের একজন নগরের একটি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। দুজন একটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। বাকি দুজন পড়ালেখায় অনিয়মিত। পিস্তলটি এখনো উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এ মামলায় দুই কিশোর জামিনে আছে।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এক কিশোরকে গুলি করতে যাওয়ার পথে পুলিশের তল্লাশিতে পড়ে একটি কিশোর দল। তারা সেখানে পুলিশকেও গুলি করার মতো কাণ্ড ঘটিয়েছে। ষোলশহরের ২ নম্বর গেট এলাকার ব্যস্ত সড়কে এ ঘটনা ঘটে। এদের দুজন শহরের দুটি নামী স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষিত ও আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সন্তান তারা। ১০ জনকে আসামি করে পুলিশ থানায় মামলা করে। তাদের তিনজন ১৮ ফেব্রুয়ারি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তারা বলে, মো. ফারুক ওরফে টোকাই ফারুক নামে যুবলীগের এক নেতা অস্ত্রটি দিয়েছেন। এই অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ফারুকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। এ মামলায় ১০ আসামির মধ্যে পাঁচজন জামিনে আছে।

টাকা লেনদেনের জেরে মায়ের সঙ্গে বিরোধে ৯ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। গত ২৫ জানুয়ারি নগরের আকবর শাহ থানার বিশ্ব কলোনি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার পাঁচ আসামির মধে৵ কিশোর রয়েছে দুজন।

গত ১১ মার্চ এক স্কুলছাত্রকে অপহরণ করে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে ৪ কিশোর। এরাও স্কুল ও কলেজপড়ুয়া। সদরঘাট থানার ওসি নেজাম উদ্দিন বলেন, মুক্তিপণের টাকা দিয়ে ইয়াবা সেবনসহ প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার কথা স্বীকার করেছে তারা।

জঙ্গিবাদেও জড়িয়ে পড়ছে কিশোরেরা। ১৯ জানুয়ারি ঢাকার নাখালপাড়ায় র‍্যাবের অভিযানে নিহত তিনজনের মধে৵ একজন নাফিস উল ইসলাম। সে চট্টগ্রাম শহরের কাজেম আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। গত বছরের ৬ অক্টোবর সে নিখোঁজ হয়। ছেলে জঙ্গি হওয়ায় লাশ বাড়িতে নেননি বাবা নজরুল ইসলাম।

গত ১৮ জুন বিকেলে চকবাজার থানার চট্টেশ্বরী রোডের একটি রেস্তোরাঁর সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, এক কিশোর আরেক কিশোরকে ছুরি দিয়ে আঘাত করছে। ওই ছুরিটি ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বের করে কিশোরের হাতে দেয় পাশে থাকা কিশোরী। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে কিশোরীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। সবাই এখন জামিনে রয়েছে। তারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে। প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে এ ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে বলে জবানবন্দিতে গ্রেপ্তার কিশোর স্বীকার করেছে।

১৭ জুন রাতে সিনেমা দেখে বাসায় ফেরার পথে মো. সুমন নামে এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে খুনের ঘটনায় ১০ কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের বয়স ১৬ বা ১৭। হালিশহরের বিভিন্ন বস্তি কলোনিতে তারা পরিবারের সঙ্গে বাস করে। রাতের বেলায় ছিনতাই ও চুরি করে থাকে। তারা সুমনকে খুন করার কথা স্বীকার করেছে।

যুবলীগের কর্মী আবু জাফর অনিক হত্যা মামলায় এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মোটরসাইকেলের হর্ন দেওয়াকে কেন্দ্র করে অনিককে ১৭ জুন রাতে নগরের চকবাজার থানার ব্যাটারি গলির মুখে খুন করা হয়।

সর্বশেষ ২৮ জুলাই রাতে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন এলাকা থেকে ১০ কিশোরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, গ্রেপ্তার শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করছে একটি চক্র। চক্রটি তাদের দিয়ে ছিনতাই ও মাদক পাচার করিয়ে থাকে।

এক কিশোর আদালত প্রাঙ্গণে প্রথম আলোকে বলেছে, পথচারীদের কাছ থেকে তারা মুঠোফোন ছিনিয়ে নেয়। পরে এটি বিক্রির টাকার ভাগ দিতে হয় তাদের বড় ভাইদের।

 সমাধান কী

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিপ্লব কুমার দে প্রথম আলোকে বলেন, আকাশ সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় কিশোরেরা যা দেখছে, বাস্তবে তা ঘটিয়ে বসছে। তারা মনের কথা মা-বাবাকে বলতে পারে না। মা-বাবারও শোনার সময় নেই। তারা বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করে। কিন্তু সন্তান কোন বন্ধুর সঙ্গে মিশছে, তার খোঁজ রাখতে পারছেন না বাবা-মায়েরা।

পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় না হওয়ায় কিশোরেরা আদর্শহীনভাবে বেড়ে উঠছে, এমনটা মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ কুণ্ডু। তিনি বলেন, সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, পরিবারকে অবশ্যই সে খেয়াল রাখতে হবে।