'পিস্তল ঠেকিয়ে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করে পুলিশ'

কিশোর আবু সাঈদ আদৌ খুন হয়নি। সে জীবিত আছে। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে। অথচ আবু সাঈদ খুন হয়েছিল বলে চার বছর আগে পুলিশ প্রতিবেদন দিয়ে আদালতকে জানিয়েছিল। সাঈদকে খুন করেছেন জানিয়ে দুজন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন, যে খুনে দুই দফা রায়ের জন্য দিন ধার্য করেছিলেন আদালত।

আবু সাঈদ ফিরে আসায় পুলিশের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই কথিত হত্যার ঘটনার আসামিরা দাবি করছেন, ডিবি অফিসে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে সাঈদ হত্যায় জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল।

কিশোর সাঈদ খুনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) রুহুল আমিন। তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘মামলা পাওয়ার পর আমি নিয়ম মেনে তদন্ত করেছি। আসামিদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আসামিরা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। দুজন আসামি (আফজাল হোসেন ও সাইফুল ইসলাম) জবানবন্দিতে বলেছিল, আবু সাঈদকে অপহরণ করে নিয়ে লঞ্চ থেকে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছিল। সোনিয়া নামের মেয়েটিও আবু সাঈদকে হত্যা করার কথা স্বীকার করেছিল।’

সাঈদ হত্যায় স্বীকারোক্তি দেন সাইফুল ইসলাম। ছবি: আসাদুজ্জামান

এই পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, ‘আবু সাঈদ যে খুন হয়নি। তাহলে সত্য কোনটা?’ এসআই রুহুল আমিন বলেন, ‘আমরা কিশোর আবু সাঈদকে উদ্ধারের জন্য অনেক খোঁজখবর করেছি। অনেক চেষ্টা করেছি। তাকে খুঁজে বের করার জন্য অনেক জায়গায় বেতারবার্তাও পাঠাই। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে আবু সাঈদ খুনের মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছি।’

কথিত খুনের ঘটনায় পুলিশের এ ধরনের তদন্তের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জণসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়টি আমরা গণমাধ্যমের মাধ্যমে জেনেছি। সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পাওয়ার পর আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখব এবং প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আবু সাঈদ খুনের মামলার চারজন আসামি হলেন বরিশালের সোনিয়া আক্তার, তাঁর ভাই আফজাল হোসেন, তাঁর ভগ্নিপতি শাহীন ও প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম। এঁদের মধ্যে আফজাল ৩৩ মাস, সাইফুল ২৪ মাস এবং সোনিয়া ৬ মাস কারাভোগ করেছেন। এখন এই তিনজন জামিনে আছেন।

মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, আবু সাঈদের বাবা আজম ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে অপহরণ মামলা করেন। আজম দাবি করেন, তাঁর ছেলে সেদিন হাজারীবাগের বড় মসজিদ মাতৃপীঠ স্কুলের উদ্দেশে রওনা হয়। কিন্তু আর বাসায় ফেরেনি। ডিবি পুলিশ তদন্ত করে আফজাল, সাইফুলসহ চারজনের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় ২০১৫ সালে অভিযোগপত্র দেয়।

সাঈদ হত্যা মামলার আসামি সোনিয়া আক্তার। ছবি: আসাদুজ্জামান

মাথায় পিস্তল ঠেকায় 

আবু সাঈদ খুনের মামলার বিচার চলছে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫–এ। গতকাল রোববার খুনের আসামি সোনিয়ার আইনজীবী ওয়াহিদুজ্জামান আদালতকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, কিশোর আবু সাঈদ খুন হয়নি। তাকে আদালতে হাজির করা হোক। এ ব্যাপারে ৫ সেপ্টেম্বর শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

গতকাল আদালতে হাজির ছিলেন কথিত খুনের আসামি সাইফুল ইসলাম। আবু সাঈদকে খুন করেছিলেন বলে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তি দেন।

স্বীকারোক্তি দেওয়ার ব্যাপারে সাইফুল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘বরিশাল থেকে কালো কাপড় বেঁধে আমাদের ঢাকার ডিবি অফিসে নিয়ে আসা হয়। চোখ বাঁধা অবস্থায় পুলিশ টর্চার করেছে। পুলিশ বলেছিল, তোমরা বলবা, তোমরা সাঈদকে লঞ্চ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছ। যদি আদালতে এই কথা বলো, তাহলে তোমাদের আর মারা হবে না। কিন্তু আমরা তো এ ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না।’

সাইফুলের দাবি, ডিবি অফিসে নিয়ে আসার পর আরও নির্যাতন করে ডিবি পুলিশ। তিনি বলেন, ‘আমরা যে কয়েক দিন ডিবি অফিসে ছিলাম, সে কয়দিন মিরাজকে (সোনিয়ার সাবেক স্বামী) ডিবি অফিসে দেখেছি। হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে আমাকে জানালার সঙ্গে বাধা হয়। আমাকে লাঠি দিয়ে মারধর করত। একদিন রাতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ডিবির পুকুরপাড়ে। এসআই রুহুল আমিন আমার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলল, “তুই যদি ঘটনা না বলিস, তাহলে তোকে মেরে ফেলব। কোনো দিন মায়ের কোলে ফিরে যেতে পারবি না।” তখন আমি বললাম, স্যার, আমাকে মারবেন না। তখন আমার মনে হয়েছিল, মরার থেকে বেঁচে থাকা ভালো। মিথ্যা কথাটা যদি সত্যভাবে বলি, বেঁচে তো থাকব। জীবনটা তো বাঁচবে। যদি আমরা স্বীকার না করতাম, তাহলে আমাদের পঙ্গু করে ফেলত।’

আরেক আসামি সোনিয়া আক্তার প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘ডিবি অফিসে নিয়ে আমাকে, আমার ভাই আফজাল, আমার বাবা ও সাইফুলকে টর্চার করেছে। আমাকেও নারী পুলিশ মারধর করেছে। পুলিশ মারধর করে আমাকে বলেছিল, তুই বলবি, তোর স্বামীকে শায়েস্তা করার জন্য সাঈদকে অপহরণ করে তোরা লঞ্চ থেকে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলেছিস। তখন আমি পুলিশকে বলেছিলাম, কেন আমি এই কথা বলব? সাঈদ কি আমার সতিনের বাচ্চা? ওকে তো আমি চিনিই না। এরপর আমার সামনে আমার ভাই আফজালকে টর্চার করেছিল পুলিশ। আমার বাবাকেও খুব মেরেছিল। চেয়ারে মোটা রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে মারছিল। তখন আমি আমার ভাই-বাবাকে টর্চারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বলেছি, হ, আমরা এই কাজ করেছি। তখন পুলিশ আমাদের বলেছিল, ওসি, ডিসি, এসপি যে আসবে, যদি জিজ্ঞাসা করে, তাদের বলবি, তোরা সাঈদকে অপহরণ করে মেরে ফেলেছিস।’

সোনিয়ার দাবি, ‘এক দিন, দুই দিন না, নয় দিন ডিবি অফিসে ফেলে নির্যাতন করে আমাদের কোর্টে হাজির করে। আমরা ডিবি অফিসের গারদঘরে ছিলাম। পুলিশ বলেছিল, তোদের বাবাকে এক শর্তে ছাড়তে পারি, যদি তোরা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিস, তাহলে তোদের বাবাকে ছেড়ে দিতে পারি। আমার বাবার মাথায়ও পিস্তল ঠেকিয়েছিল। বলেছিল, তোরা যদি কোর্টে গিয়ে না বলস, তাহলে তোর বাবাকে মেরে ফেলব। আমরা ভাবছি, সত্যি আমাদের মেরে ফেলবে। পরে আমরা বলছি, হ, আমরা কোর্টে গিয়ে বলব।’ সোনিয়া জানান, ওই ঘটনার পর থেকে তাঁর বাবা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই রুহুল নির্যাতন করার সব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, কোনো ধরনের নির্যাতন সোনিয়াদের করা হয়নি। সোনিয়া, আফজাল ও সাইফুল স্বেচ্ছায় আদালতে স্বীকার করেছিলেন যে তাঁরা সাঈদকে লঞ্চ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছেন।

বাবা-মায়ের সঙ্গে কিশোর সাঈদ। ছবি: সংগৃহীত

সাঈদ এত দিন কোথায় ছিল

গত বৃহস্পতিবার কিশোর সাঈদসহ তার মা–বাবাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আদালতের অনুমতি নিয়ে হাজারীবাগ থানার পুলিশ তাঁদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করার অভিযোগে মামলা করেছেন সোনিয়া আক্তার।

এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও হাজারীবাগ থানার এসআই লন্ডন চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আবু সাঈদকে যে লঞ্চ থেকে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়নি, তা সত্য। কারণ, আবু সাঈদ জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, ২০১৪ সালে সে কাউকে না বলে গাজীপুরে চলে গিয়েছিল। তবে কবে ফিরে এসেছে, তা নির্দিষ্ট করে বলছে না। তার মা–বাবাও দাবি করছেন, সাঈদ কোথায় ছিল, তাঁরা জানতেন না। তবে সাঈদের মুঠোফোন নম্বর জানা গেছে। মোবাইলের তথ্য পর্যালোচনায় অনেক তথ্য জানা যাবে।

পুরো ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটনের জন্য মামলার প্রধান আসামি সোনিয়ার সাবেক স্বামী মিরাজ হোসেনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে দাবি করেছেন এসআই লন্ডন চৌধুরী। তিনি বলেন, মিরাজ হোসেনকে গ্রেপ্তার করা গেলে আরও অনেক তথ্য জানা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন:
বিচারের শেষ পর্যায়ে জানা গেল ছেলেটি খুন হয়নি