সাইবার অপরাধের বিচারের জন্য ২০০৬ সালে বিএনপি–জামায়াত সরকার আইসিটি আইন করে। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বিচারের জন্য সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে ২ হাজার ৬৬৯টি মামলা আসে। প্রথম আলো দুই বছর ধরে মামলাগুলোর তথ্য সংগ্রহ করেছে। তার ভিত্তিতে করা তিন পর্বের ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব ছাপা হলো আজ।
সাইবার অপরাধের ঘটনায় করা মামলার বেশির ভাগ অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারছে না। গত সাত বছরে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে ৭৬৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সাজা হয়েছে মাত্র ২২টি মামলায়। শতকরা হিসাবে সাজার হার ২ দশমিক ৮৬। বাকি ৯৭ দশমিক ১৪ শতাংশের বেশি মামলায় আসামিরা অব্যাহতি অথবা খালাস পেয়েছেন। ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালের দৈনন্দিন কার্যতালিকাসহ মামলাসংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
তবে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগে এসব মামলার অনেক আসামিকে কারাগারে যেতে হয়েছে। অনেককে পুলিশি রিমান্ডেও থাকতে হয়েছে। আসামি ও আইনজীবীদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, এলাকায় টিকে থাকার জন্য তাঁদের বাদীর সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক বা আর্থিক প্রক্রিয়ায় আপস–মীমাংসায় পৌঁছাতে হয়েছে। বিচারপ্রক্রিয়ায় অংশ নিতে গিয়ে আর্থিক, মানসিক ও শারীরিক ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু আইনে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা না থাকায় শেষ পর্যন্ত কোনো প্রতিকারও পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা।
২০১৩ সাল থেকে গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলো দুই বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করেছে প্রথম আলো। এই সময়ে সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য মামলা এসেছে ২ হাজার ৬৬৯টি। অনিষ্পন্ন মামলাগুলোর বিচারকাজ এখন আটটি বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালে চলছে। এসব মামলায় মোট আসামি প্রায় সাড়ে তিন হাজার।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন (আইসিটি) এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারার বিরুদ্ধে শুরু থেকেই সোচ্চার ছিল গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংগঠনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সব পক্ষের অভিযোগ ছিল, এর মাধ্যমে মানুষের কথা বলার অধিকার সংকুচিত হবে। উদ্দেশ্যমূলক হয়রানির কারণে সমাজে ভীতির সঞ্চার হবে এবং সর্বোপরি মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হবে। আইনজ্ঞরা বলছেন, ৯৭ শতাংশের বেশি মামলায় আসামির খালাস বা অব্যাহতির তথ্য এ আশঙ্কাগুলোকে সত্য প্রমাণ করছে।
নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলো হয়েছে আইসিটি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারায়। সাজা হওয়া ২২ মামলার ২০টি আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় করা। এ ধারায় শাস্তি ৭ থেকে ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং এক কোটি টাকা জরিমানা। বাকি দুটি মামলার একটি আইসিটি আইনের ৫৪ ও ৬৬ ধারায় এবং অন্যটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় করা।
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার অপরাধের মধ্যে আছে ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ করে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, ব্যক্তি ও সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া ইত্যাদি। এ আইনের অপব্যবহারের অভিযোগ তুলে ধরে মানবাধিকার ও গণমাধ্যমকর্মী এবং নাগরিক সমাজ এ ধারা বাতিলের দাবি তুলেছিল। ২০১৮ সালে সরকার ৫৭ ধারাসহ তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের চারটি ধারা বিলুপ্ত করে। ওই বছরই সাইবার অপরাধের বিচারের জন্য সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে নতুন আইন করে। এরপর থেকে সাইবার অপরাধের সব মামলা এ আইনে হচ্ছে।
ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হওয়া ৭৬৮ মামলার মধ্যে ৫২৯টিতেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। আদালত চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে আসামিদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। শতকরা হিসাবে তা ৬৮ দশমিক ৮৮ ভাগ।
নিষ্পত্তি হওয়া বাকি মামলাগুলোর মধ্যে ১০৭টি মামলার শুনানি নিয়ে অভিযোগ গঠনের আগে আদালত আসামিদের অব্যাহতি দিয়েছেন। আর বিচারপ্রক্রিয়ার শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় ১১০টি মামলার আসামিদের বেকসুর খালাস দেন আদালত। সব মিলিয়ে ৯৭ ভাগ মামলায় আসামিরা অব্যাহতি বা খালাস পেয়েছেন। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ছিল প্রায় ৮৫০।
সাইবার ট্রাইব্যুনালের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে, এমন মামলার মধ্যে আইসিটি আইনে করা হয়েছিল ৪৯৯টি। এর ৪৬৮টিই হয়েছে ৫৭ ধারায়। বাকি মামলাগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা।
জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করা যে পোস্ট নিয়ে মামলা হয়, তদন্তকালে আর ওই পোস্ট পাওয়া যায় না। আসামিরা তা মুছে ফেলেন। অনেক মামলায় সাক্ষী আসেন না। তাই শেষ পর্যন্ত আর অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না।
সাজার হার কম হওয়ার বিষয়ে পিপি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সাজার হার কম হওয়ার বেশ কিছু কারণ আছে। ৫০ থেকে ৬০টি মামলা আমার নোট করা আছে, যেসব মামলায় সাজা হওয়ার নিশ্চিত উপাদান আছে। কিন্তু বাদী, বাদীর মা–বাবা, বাদীর ভাই আমাদের কাছে এসে বলেন, স্থানীয়ভাবে আপস-মীমাংসা হয়ে গেছে। আমরা এখন আসামিদের খালাস চাচ্ছি।’
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তকালে মূল কাজ হলো মামলার আলামত সংগ্রহ করে তা আদালতে জমা দেওয়া। সাক্ষ্য সংগ্রহে যখনই এদিক-ওদিক হয়, তখন কিন্তু সেভাবে অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না। চূড়ান্ত রিপোর্ট দিতে হয়। তিনি বলেন, ‘সাইবার অপরাধের মূল বিষয় কিন্তু ল্যাবনির্ভর। আমরা ডিবিতে যেসব মামলা নিয়ে কাজ করি, সেগুলো কিন্তু সাক্ষ্য সংগ্রহ করি। আর সাজার হার যদি কম হয়, তাহলে তদন্তের বিষয়টি ভালোভাবে দেখা দরকার।’
সাতক্ষীরা সদরের হাড়দ্দাহ গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী খালিদ হোসেন ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর রাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ও ২৯ ধারার মামলায় গ্রেপ্তার হন। ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর ছবি বিকৃত করে প্রচারের অভিযোগ এনে তাঁর বিরুদ্ধে সদর থানায় মামলা করেন স্থানীয় ভোমরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী আবদুল গফুর। খালিদ গ্রেপ্তার হয়ে এক মাস কারাভোগ করেন। উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিতে হয় তাঁকে। পরে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, খালিদ হোসেন তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রধানমন্ত্রীর কোনো ছবি বিকৃত করে প্রচার করেননি। গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর তাঁকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন জানিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ।
খালিদ হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কোনো ছবি বিকৃত করে আমি ফেসবুকে প্রচার করিনি, তবু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় এক মাস জেল খাটলাম। চরম হয়রানির শিকার হলাম।’ তিনি জানান, এই মামলার শুরু থেকে অব্যাহতি পাওয়া পর্যন্ত কারাগারে থাকা, হাইকোর্ট থেকে জামিন নেওয়া, ঢাকায় ট্রাইব্যুনালে বারবার হাজিরা দেওয়া, থাকা, খাওয়া, যাতায়াত—সব মিলিয়ে এক লাখ টাকার ওপরে খরচ হয়েছে।
জানতে চাইলে মামলার বাদী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল গফুর মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে আপত্তিকর ছবি, লেখা প্রচারের অভিযোগেই খালিদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। কিন্তু পুলিশ যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, তা আমাকে জানায়নি।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাতক্ষীরা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মানিক কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিষয়টি বাদীকে জানানো হয়েছিল। আসামির মুঠোফোন সিআইডিতে ফরেনসিক পরীক্ষা করে অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। তাহলে মামলা নেওয়া হলো কেন? জবাবে তিনি বলেন, বাদী খালিদ হোসেনের ফেসবুক পোস্টের একটি স্ক্রিনশট দিয়ে থানায় মামলা করেছিলেন।
এই দুই আইনেই হয়রানির সুযোগ থাকায় তদন্তের আগে আসামি গ্রেপ্তার না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন একাধিক মানবাধিকারকর্মী। মানবাধিকারকর্মী নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই এমন আশঙ্কা জানিয়ে আসছি। একজন মানুষ গ্রেপ্তার হচ্ছেন, জেল খাটছেন, দিনের পর দিন আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন, সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন, তারপর মামলা থেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন।’ তিনি বলেন, এ থেকে শিক্ষা নিয়ে তদন্তের আগে হুটহাট গ্রেপ্তার করা বন্ধ করতে হবে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, সাইবার ট্রাইব্যুনালে আইসিটি আইনে বিচারাধীন যত মামলা, সেগুলোর ৯৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ হয়েছে বিতর্কিত ৫৭ ধারায়। বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে আসা আইসিটি আইনের ২ হাজার ২৬১টি মামলার মধ্যে ২ হাজার ১৪০টি ৫৭ ধারায় করা। বাকি মামলা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা হয়।
৫৭ ধারার অপরাধগুলোকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চারটি ধারায় সংযুক্ত করা হয়। এই চার ধারা হচ্ছে ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১। ঢাকা ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা আসে ৪০৮টি। এই আইনের প্রায় অর্ধেক মামলা ২৫, ২৯ ও ৩১ ধারায় করা। ২৫ ধারা হচ্ছে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ ও প্রকাশ। ২৮ ধারা হচ্ছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত। আর ২৯ ধারা হচ্ছে মানহানি। আর ৩১ ধারা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, ৫৭ ধারায় করা সাত বছরের পুরোনো ১০টি মামলার বিচার এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এ ছাড়া ছয় বছরের পুরোনো ৭২টি মামলার বিচার চলমান। পাঁচ বছরের পুরোনো মামলা আছে ১২৫টি। চার বছরের পুরোনো মামলার সংখ্যা ৩৭৭।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে উসকানি দেওয়ার অভিযোগে ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে গ্রেপ্তার করে তাঁর বিরুদ্ধে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করে পুলিশ। অভিযোগ আনা হয়, শহিদুল আলম তাঁর ফেসবুকে ও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে কল্পনাপ্রসূত অপপ্রচার করেছেন, যা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। তিনি সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশকে অকার্যকর রূপে উপস্থাপন করেছেন। এক মাসের বেশি সময় কারাভোগের পর শহিদুল আলম জামিনে মুক্ত হন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলাটির কার্যক্রম এখন স্থগিত রয়েছে।
ঢাকায় সাইবার অপরাধের আলোচিত মামলার মধ্যে আছে লেখক মুশতাক আহমেদ ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোর, অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান; লেখক ও প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিক ও তাঁর ভাই শামসুল আলম; সাংবাদিক প্রবীর শিকদার, গবেষক আফসান চৌধুরী প্রমুখের বিরুদ্ধে মামলা। সারা দেশে আইসিটি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনেক বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, মানবাধিকারকর্মীসহ সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। সাংবাদিক প্রবীর শিকদার সম্প্রতি এই মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন।
সাইবার অপরাধের বিচারের জন্য ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আইসিটি আইন করে। এই আইনের মামলার বিচারের জন্য সাত বছর পর ২০১৩ সালে ঢাকায় সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আওয়ামী লীগ সরকার। গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এই ট্রাইব্যুনালে ২ হাজার ৬৬৯টি মামলা বিচারের জন্য জমা হয়। ফলে মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিপুল অর্থ খরচ করে মাসের পর মাস ঢাকায় আসতে হয়েছে। এদিকে সাইবার অপরাধের মামলাও দ্রুত বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় গত ৪ এপ্রিল সরকার আরও সাতটি বিভাগীয় শহরে সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এরপর ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগে দায়ের করা অনিষ্পন্ন মামলা নিজ নিজ ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা আছে ১ হাজার ৩৬২টি। উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০টি মামলা স্থগিত আছে।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সাতটি জাতীয় পত্রিকা এবং কয়েকটি আঞ্চলিক পত্রিকার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ১০৯টি মামলার খবর বিশ্লেষণ করেছে প্রথম আলো। তাতে দেখা যায়, বেশির ভাগ মামলাই হয়েছে কটূক্তি, মানহানিকর বক্তব্য, বিকৃত ছবি শেয়ার, গুজব ছড়ানোর অভিযোগে। তিন-চতুর্থাংশের বেশি অভিযোগই সরকার, সরকারি দলের লোকজন ও সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে বিরূপ কথা বলা নিয়ে (৮৫টি)। কয়েকটি মামলা হয়েছে ধর্ম নিয়ে কটূক্তি বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে। আছে ভুল সংবাদ পরিবেশনের অভিযোগও। কিন্তু সাইবার ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার তথ্য বলছে, এ ধরনের অভিযোগের ৯৭ ভাগই আদালতে টিকছে না।
দণ্ডবিধি অনুযায়ী, মিথ্যা মামলা করা দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মিথ্যা মামলাকারীর শাস্তির সুনির্দিষ্ট কোনো ধারা উল্লেখ নেই। তবে সাইবার ট্রাইব্যুনালের পিপি বলেছেন, আদালতে যদি প্রমাণিত হয় কেউ মিথ্যা মামলা করছেন, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি দণ্ডবিধিসহ অন্যান্য আইন অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী মনে করেন, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি কিংবা ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির বাইরে কেউ মানহানির মামলা করতে পারবেন না—ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এমন একটি উপধারা সংযুক্ত করা উচিত। তাতে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা করার প্রবণতা কমবে।
আইসিটি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে শুরু থেকে বিতর্ক ছিল। এখন আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে সফলতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তদন্ত প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। শুরু থেকেই আইনটি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিল মানবাধিকার সংগঠনগুলো। এখন দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক কারণে যেমন মামলা হচ্ছে, তেমনি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দেনদরবার করে সমঝোতাও হচ্ছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অধিকাংশ মামলায় আসামিরা বাদীর পরিচিত, প্রতিবেশী বা রাজনৈতিকভাবে বিপক্ষ দলে অবস্থান করছেন। এমনকি জমিজমার বিরোধের কারণে হয়রানি করার জন্যও এ আইনে মামলা করা হচ্ছে। যেমন সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার মীরগাঁও গ্রামের আবুল কালাম ২০১৮ সালে তিন প্রতিবেশীর নামে বিশ্বনাথ থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। অভিযোগ ছিল, তাঁরা যোগসাজশ করে বাদীর নামে ফেসবুক আইডি খুলে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র ছড়িয়েছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা গ্রামের আতাউর রহমান, আতিকুর রহমান ও মুজিবুর রহমান। আতিকুর রহমান ও মুজিবুর রহমান আপন ভাই। মুজিবুর বর্তমানে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী।
মামলাটি সাড়ে চার বছর ধরে চলছে। আতাউর রহমানের দাবি, জমিজমা নিয়ে বিরোধের জেরে আবুল কালাম মিথ্যা অভিযোগ এনে মামলাটি করেছেন। নিজেকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দাবি করে আতাউর প্রথম আলোর সিলেট প্রতিনিধি মানাউবী সিংহকে বলেন, ‘দলীয় নেত্রী ও দেশের প্রধানমন্ত্রীর নামে আমি কেন ব্যঙ্গচিত্র রটাব।’
আতাউর রহমান বলেন, ‘প্রথম দফায় আমরা তিনজনই উচ্চ আদালত থেকে আট সপ্তাহের জামিনে ছিলাম। কিন্তু জামিনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি মনে না থাকায় আমাদের নামে ওয়ারেন্ট জারি হয়। আমরা গ্রেপ্তার হয়ে গেলাম। পরে আবার জামিন নিই।’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাকে ‘অনেক জটিল মামলা’ দাবি করে তিনি বলেন, ‘দুইবার জামিন, ঢাকায় আসা–যাওয়া, মামলায় হাজিরা দেওয়া—সব মিলিয়ে পাঁচ লাখ টাকার মতো খরচ হয়ে গেছে। এখন আপস–মীমাংসার প্রক্রিয়ায় চলছে।’
সাড়ে চার বছর পর এখন বাদী আবুল কালামও প্রথম আলোকে বলছেন, ‘ভুল–বোঝাবুঝি থেকে মামলাটি হয়েছিল। এখন আপসের পর্যায়ে আছি। মামলায় কিছু টাকাপয়সা খরচ হয়েছে। যেহেতু আপসের পর্যায়ে আছি, তাই আর বেশি কিছু বলছি না।’
তিন মাস আগে দায়িত্বে আসা বিশ্বনাথ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গাজী আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ এলে প্রাথমিকভাবে তদন্ত করা হয়। সত্যতা পেলে মামলা রেকর্ড করা হয়। নিরপরাধ কারও হয়রানি কিংবা ভোগান্তির সুযোগ নেই।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিব উল–আলম প্রথম আলোকে বলেন, আইসিটি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা নিষ্পত্তির এ তথ্য বলছে, এ দুটি আইন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমাজে যে আশঙ্কা প্রচলিত আছে, তা এখন মোটামুটি প্রামাণিক ভিত্তি পাচ্ছে। ৯৭ ভাগ মামলার অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারার অর্থ হচ্ছে আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। আইনের অপব্যবহার ও হয়রানি নিয়ন্ত্রণে করণীয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে আটকের বিধানটি পর্যালোচনা করতে হবে। তদন্ত শেষ না করে কাউকে আটক করা যাবে না। পাশাপাশি জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা করতে হলে সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। তাহলে নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা দেওয়া যাবে। মিথ্যা অভিযোগে বা হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলা করা হয়েছে প্রমাণিত হলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আইনে রাখতে হবে। তাহলে কেউ আর আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।