বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি

৪৪ লাখ টাকার খাবার কেনায় ভুয়া রসিদ

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানের মহড়ায় শিল্পীদের খাবার কেনায় মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি
ছবি: প্রথম আলো

শিল্পীদের আপ্যায়নের জন্য ১৯ দিনে কেনা হয়েছে ৭ লাখ ৯৬ হাজার টাকার খাবার। রসিদে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নাম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে শর্মা হাউসের হাতিরপুল শাখার নাম। সেখানে গিয়ে জানা গেল, যে খাবারের কথা রসিদে লেখা আছে, তা তারা বিক্রিই করে না। রসিদগুলোও তাদের নয়।

এই ভুয়া রসিদ তৈরির অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির বিরুদ্ধে। শুধু শর্মা হাউস নয়, আরও প্রতিষ্ঠান থেকে মোট প্রায় ৪৪ লাখ টাকার খাবার কেনার বিলে ব্যবহার করা হয়েছে এমন ভুয়া রসিদ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, এর সঙ্গে জড়িত শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী ও তাঁর ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মহড়ার জন্য এই খাবার কেনা হয়। অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের কাছ থেকে শিল্পকলা একাডেমি সাড়ে চার কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছিল। এর মধ্যে শিল্পীদের আপ্যায়নের জন্য সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৪৭ লাখ টাকার খাবার কেনা হয়। এর বাইরে মহড়ায় অংশ নেওয়া শিল্পীদের আপ্যায়নের জন্য আরও ৪৩ লাখ ৮৭ হাজার ৩৩৪ টাকার বিল দেখানো হয়। প্রশ্ন উঠেছে এই ব্যয়টি নিয়ে।

ভুয়া রসিদে খাবার কেনার অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলীর মুঠোফোনে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কল করা হয়। খুদে বার্তাও পাঠানো হয়। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে একাডেমির জনসংযোগ কর্মকর্তা হাসান মাহমুদের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। তিনি (হাসান মাহমুদ) বলেন, ভুয়া বিল-ভাউচারের বিষয়টি তাঁদের চোখে পড়েছে। তাই মহাপরিচালক ফাইল অনুমোদন করেননি। বিলও পরিশোধ করা হয়নি। অনিয়মটি তদন্তে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি তাঁর জানা নেই।

শিল্পকলায় যা হচ্ছে, তা ভালো লাগছে না। লিয়াকত আলীর উচিত নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা। নইলে এই পদগুলো সংস্কৃতিজগতের লোকদের হাতে থাকবে না।
মামুনুর রশীদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

অবশ্য শিল্পকলা একাডেমি সূত্র ও নথিপত্র বলছে, রসিদের ক্ষেত্রে নানান অসংগতি পাওয়ায় একাডেমির তৎকালীন সচিব নওশাদ হোসেন শুরুতে বিলে সই করেননি। তিনি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনসংক্রান্ত শিল্পকলা একাডেমির যাতায়াত ও আপ্যায়ন উপকমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। বিল উপস্থাপন করেছিলেন শিল্পকলা একাডেমির প্রশাসন বিভাগের সংস্কৃতিবিষয়ক কর্মকর্তা (কালচারাল অফিসার) আসাফ-উদ-দৌলা।

সূত্র আরও বলছে, বিলের অনুমোদন দিয়ে একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী ফাইল সচিবের কাছে পাঠালে চাপে পড়ে তিনি (সচিব) সই করতে বাধ্য হন। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে নওশাদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

‘এই রসিদ আমাদের নয়’

শিল্পকলা একাডেমির কেনাকাটার রসিদে শর্মা হাউসের হাতিরপুল শাখা থেকে কেনা খাবারের তালিকায় রয়েছে সমুচা, কমলা, চিকেন বন, পেট্রিস, আপেল ইত্যাদি। রসিদের অনুলিপি নিয়ে শর্মা হাউসের হাতিরপুল শাখায় গেলে শাখাটির ব্যবস্থাপক জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব খাবার আমরা বিক্রি করি না। এই রসিদও আমাদের নয়।’ তিনি আরও জানান, তাঁদের প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) যন্ত্রে রসিদ তৈরি করা হয়। ছাপানো রসিদে হাতে লিখে বিল দেওয়া হয় না।

জিয়াউল হক আরও জানান, রসিদগুলো সঠিক কি না তা জানতে গত বছরের ২৮ মে রাত সাড়ে আটটার দিকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া কয়েকজন ব্যক্তি এসেছিলেন। তাঁদেরও তিনি রসিদগুলো ভুয়া বলে জানিয়েছেন।

শর্মা হাউসের বাইরে আরও ৯টি প্রতিষ্ঠান থেকে একই অনুষ্ঠানের জন্য খাবার কেনার কথা উল্লেখ করেছে শিল্পকলা একাডেমি। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ফুড হাট (সেগুনবাগিচা), নান্না বিরিয়ানি (পুরানা পল্টন), ফুড ফেয়ার (সেগুনবাগিচা), এনজয় (সেগুনবাগিচা), মেট্রো ফুডস (বিজয়নগর), সুন গার্ডেন (বিজয়নগর), সেগুন রেস্টুরেন্ট (সেগুনবাগিচা), নাহিন এন্টারপ্রাইজ (উত্তর বাসাবো) ও রয়েল ক্যাফে (ভাটারার বেরাইদ)।

শিল্পকলা যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে বেশি খাবার কিনেছে বলে দেখিয়েছে, এমন চারটি দোকানে গিয়ে মালিক ও কর্মচারীদের রসিদ দেখানো হয়। তাঁরা সবাই জানিয়েছেন, এসব রসিদ তাঁদের নয়।

শিল্পকলা একাডেমি দেখিয়েছে, তারা ঢাকার সেগুনবাগিচার ফুড হাট নামের একটি খাবারের দোকান থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার খাবার কিনেছে। দোকানটিতে গিয়ে শিল্পকলার রসিদ দেখালে বিক্রেতা মো. রুবেল বলেন, তাঁরা রসিদ দেন ইসিআর যন্ত্রে প্রিন্ট করে। খাবারের নাম থাকে ইংরেজিতে। শিল্পকলার রসিদ হাতে লেখা, নাম বাংলায়। তারা তাদের ইচ্ছেমতো খাবারের নাম লিখে বিল তৈরি করেছে।

শিল্পকলার রসিদ অনুযায়ী, সেগুনবাগিচা এলাকার ফুড ফেয়ার নামে একটি খাবারের দোকান থেকে তারা ২০২১ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার খাবার কিনেছে। দোকানটির মালিক এম এ রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, এই রসিদ তাঁর দোকানের নয়। এর আগে সরকারি আরেকটি সংস্থা তাঁর দোকানের নামে ভুয়া রসিদ তৈরি করেছিল।

শিল্পীরা যা বলছেন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়ায় অংশ নেওয়া একাধিক শিল্পীর সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিল্পীরা বলেন, তাঁদের খাবার দেওয়া হয়েছিল, তবে বাক্সে কোনো প্রতিষ্ঠানের লোগো ছিল না। শর্মা হাউসের মতো সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানের খাবার তাঁরা পাননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নৃত্যশিল্পী প্রথম আলোকে বলেন, খাবারের মানও তেমন ভালো ছিল না।

তদন্তে দুদক

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি জাতীয় সংস্কৃতিকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এটি সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান। এক যুগ ধরে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকের দায়িত্বে আছেন লিয়াকত আলী। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২ জানুয়ারি এ সিদ্ধান্তের কথা জানান সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তা আরিফ সাদেক। তিনি আরও জানান, দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।