অনেক মামলার রায়ে আদালত তদন্তের দুর্বলতাসহ নানা পর্যবেক্ষণ দেন। পর্যবেক্ষণগুলো আমলে না নেওয়ায় আসামি খালাসের সংখ্যা বাড়ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দায়ের করা মামলার মধ্যে ২৩ হাজার ৫৩৫ মামলায় সব আসামি খালাস পেয়ে গেছেন। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ২৬ হাজার ১৩৮। এই আসামিরা মাদকসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বলে মামলার এজাহার ও অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল। কিন্তু এজাহার ও তদন্তে দুর্বলতা, সাক্ষী হাজির করায় ব্যর্থতাসহ নানা কারণে এসব আসামির বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি। ফলে আদালত এই বিপুলসংখ্যক মামলায় আসামিদের খালাস দেন।
গত ২০ বছরে নিষ্পত্তি হওয়া মামলা পর্যালোচনা করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালন (অপারেশনস) শাখা এই চিত্র পেয়েছে। ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত নিষ্পত্তি হওয়া মামলার তথ্য-উপাত্ত তাদের বিশ্লেষণে স্থান পায়। এই সময়ে মোট মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৬ হাজার ৯০৭টি। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক (৫০ দশমিক ১৭ শতাংশ) মামলা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও রাষ্ট্রপক্ষ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, এসব মামলার বাদী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। আর অধিকাংশ মামলা তদন্তও করেছে অধিদপ্তর। পুলিশও কিছু মামলা তদন্ত করেছে। খালাসের কারণ হিসেবে সব পক্ষই বলছে, ত্রুটিপূর্ণ এজাহার ও অভিযোগপত্র, বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী উপস্থাপন করতে না পারা এবং জব্দতালিকা সঠিকভাবে না করায় আসামিরা সুবিধা পেয়েছেন। জব্দতালিকার সাক্ষীদের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যে অমিল, বাদী ও অভিযানকারীদের বক্তব্যে অমিল থাকার কারণেও অপরাধ প্রমাণ করা যায়নি। আবার অনেক কর্মকর্তা মাদক উদ্ধারে মনোযোগী হলেও তদন্তে কম আগ্রহ দেখিয়েছেন। ফলে আদালতে দায়সারা অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ২০ বছরে নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় আসামি ছিলেন ৫০ হাজার ৫৯৯ জন। এর মধ্যে খালাস পেয়েছেন ২৬ হাজার ১৩৮ জন। অর্থাৎ মামলায় যাঁদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার দাবি তদন্ত কর্মকর্তা করেছেন, তাঁদের ৫২ দশমিক ২৩ শতাংশ খালাস পেয়েছেন। সবশেষ ২০২০ সালে খালাস পান ৫৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ আসামি। গত পাঁচ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মাদকের মামলায় আসামি খালাসের হার ৫৫ থেকে ৬১ শতাংশের মধ্যে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়ার আগে অভিজ্ঞ সরকারি কৌঁসুলির আইনি মতামত নেওয়া উচিত। আইনের বাধ্যবাধকতা অনুসরণ করে সরকারি কৌঁসুলির মতামত নিয়ে তদন্ত করলে এ ধরনের আসামি খালাসের হার অনেক কমে আসবে। এহসানুল হক সমাজী , ফৌজদারি বিষয়ে অভিজ্ঞ আইনজীবী
মামলা নিষ্পত্তি ও খালাসের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর একই চিত্র দেখা গেলেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বা পুলিশ পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। গত ২০ বছরে নিষ্পত্তি হওয়া মাদক মামলার প্রবণতা দেখলে তা পরিষ্কার বোঝা যায়। আবার এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পদক্ষেপের কথাও জানা যায়নি। কিন্তু প্রতিবছরই নিজেদের পর্যালোচনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মামলা প্রমাণে ব্যর্থতার এই চিত্র পেয়ে আসছিল।
এ নিয়ে কোনো কর্মকর্তা সরাসরি কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মামলার তদন্ত তদারকির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মাদক আইনে মামলার তদন্তে খুব বেশি সময় নেওয়া যায় না। দ্রুততম সময়ে অভিযোগপত্র দিয়ে দিতে হয়।
এ কারণে এজাহারের ওপর ভিত্তি করেই অধিকাংশ মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়ার একটা প্রবণতা আছে। ফলে মামলায় অনেক ত্রুটি থেকে যায়।
চার বছর আগে ঢাকার দক্ষিণখানে অভিযান চালিয়ে ৫০০ ইয়াবাসহ পাঁচ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। দক্ষিণখান থানায় মামলা করে অধিদপ্তর। তদন্ত শেষ করে পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু এজাহারে ত্রুটি ও জব্দ আলামত শনাক্ত না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে পাঁচ আসামিকেই আদালত খালাস দেন।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু প্রথম আলোকে বলেন, এজাহারে ত্রুটি থাকলে, সঠিকভাবে জব্দতালিকা না হলে আসামিরা সুযোগ পেয়ে যান। তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি এবং বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী উপস্থাপন না কারণেও অনেক মামলা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
আসামির সহযোগীদের অপরাধও প্রমাণ করা যায় না
চার বছর আগে কুষ্টিয়ার মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়ে দৌলতপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ৮০০ গ্রাম হেরোইনসহ দুজনকে আটক করেন। ওই ঘটনায় গ্রেপ্তার দুই আসামির সঙ্গে তাঁদের আট সহযোগীকে শনাক্ত করে মামলা করেন পরিদর্শক তারেক মাহামুদ। তদন্ত শেষে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় দৌলতপুর থানা-পুলিশ। কিন্তু আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ আট সহযোগীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। ২০১৯ সালের অক্টোবরে এই মামলায় দুই আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। কিন্তু তাঁদের আট সহযোগীকে খালাস দেওয়া হয়।
এই মামলার বাদী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক তারেক মাহামুদ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, গ্রেপ্তার দুজনের সঙ্গে এজাহারে উল্লেখ করা আটজন একই মাদক চক্রের সদস্য। সেই অনুযায়ী মামলা করা হয়। আদালত আট সহযোগীকে খালাস দিয়েছেন। এ বিষয়ে তো আর করার কিছু নেই।
তদন্ত কর্মকর্তা এজাহারভুক্ত আসামিদের নাম উল্লেখ করে অভিযোগপত্র দেন। অনেক মামলায় এজাহারের বাইরে কোনো তথ্য পাওয়া গেলেও তা উল্লেখ করেন না তদন্ত কর্মকর্তা। আবার আসামির সহযোগীদের অপরাধের বিষয়ে বিস্তারিত তদন্তও করেন না কেউ কেউ। এসব ক্ষেত্রে সহযোগীদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানান আইনজীবীরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (লজিস্টিকস, ফিন্যান্স অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট) এ এফ এম মাসুম রব্বানী এর আগে দুই বছর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাদক আইনে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। তারপরও কোনো পর্যায়ের মানসম্পন্ন তদন্ত হলে সহযোগীসহ আসামিদের সাজা নিশ্চিত করা যায়, তাতে জোর দিতে হবে। আবার মানসম্পন্ন তদন্তের পরও কোনো একটি বিষয়ে যদি আদালত সন্তুষ্ট না হন, তাহলে সাজা না দেওয়ার এখতিয়ার তাঁর আছে।
আদালতের পর্যবেক্ষণ আমলে নেওয়া হয় না
২০১৭ সালের মে মাসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি মামলার রায়ে মাদকসহ গ্রেপ্তার আসামিকে খালাস দেন পিরোজপুরের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, মামলার বাদী এবং তদন্ত কর্মকর্তা একই ব্যক্তি। তাঁকে নিরপেক্ষ সাক্ষী হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। পর্যাপ্ত সময় পাওয়ার পরও রাষ্ট্রপক্ষ সব সাক্ষী হাজির না করায় আসামিপক্ষ সুবিধা পেয়েছে। আসামিকে হাতেনাতে মাদকসহ আটকের বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, অধিকাংশ মামলার রায়ে আদালত পর্যবেক্ষণ দেন। তদন্তের নানা দুর্বলতার কথা তুলে ধরেন। গ্রহণযোগ্য সাক্ষী হাজির করতে না করার কথা বলেন। মামলার বাদী এবং তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতির কথাও পর্যবেক্ষণে উঠে আসে। কিন্তু এসব বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে আবারও একই দুর্বলতাসহ মামলা ও তদন্ত করায় আসামি খালাসের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবদুস সবুর মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালত অনেক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে রায় দেন। আসামিদের অপরাধ প্রমাণে আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকে না। মামলার এজাহার দায়ের এবং তদন্তে যেন ত্রুটি না থাকে সে জন্য কর্মকর্তাদের নিয়মিত দিকনির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
অবশ্য গত পাঁচ বছরে নিষ্পত্তি হওয়া অধিদপ্তরের মামলার তথ্য ভিন্ন কথা বলছে। কারণ, নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় সব আসামি খালাসের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যেমন ২০১৬ সালে ৫৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ মামলায় সব খালাস পেয়েছিলেন। গত বছর এই হার ছিল ৫৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর গত ২০ বছরে (২০০১-২০২০) মোট ১ লাখ ৮৮ হাজার ৬৭৮টি মামলা করেছে। এসব মালায় মোট আসামি ২ লাখ ৪ হাজার ৭৬৩ জন। এই সময়ের মধ্যে ৪৬ হাজার ৯০৭ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
এ থেকে উত্তরণের জন্য কিছু পরামর্শ দিয়েছেন ফৌজদারি বিষয়ে অভিজ্ঞ আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়ার আগে অভিজ্ঞ সরকারি কৌঁসুলির আইনি মতামত নেওয়া উচিত। আইনি মতামত অনুসরণ করে অভিযোগপত্র দাখিল করা হলে অভিযোগ প্রমাণ করা সহজ হবে। আইনের বাধ্যবাধকতা অনুসরণ করে সরকারি কৌঁসুলির মতামত নিয়ে তদন্ত করলে এ ধরনের আসামি খালাসের হার অনেক কমে আসবে।