একটি বেঞ্চের ওপর চাদরে মুড়িয়ে রাখা ছোট্ট শরীর। চারপাশে নারীদের জটলা, আশপাশে ছিলেন নানা বয়সী আরও মানুষ। উঁকি দিয়েই তৎক্ষণাৎ তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। ফিরিয়ে নেওয়া সেই মুখগুলো ছিল বেদনায় ক্লিষ্ট। জটলার ভেতর থেকেই উঠছিল তাঁদের ভারী দীর্ঘশ্বাসের ঘূর্ণি। অস্ফুট স্বরে তাঁদের স্বগতোক্তি, ‘ইস, বাচ্চাটা কি ফুটফুটে ছিল।’
হ্যাঁ, বাচ্চাটি ফুটফুটেই ছিল। পৃথিবীতে আসার বয়স হয়েছিল মোটে ১৬ দিন। বাবা-মা, খালা ও ছোট বোনের কোলই ছিল তার জগৎ। মিরপুরের আহম্মদনগরের জোনাকি রোডের জীর্ণ একটি টিনশেড বাড়িতে তার বয়সের সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা আর দিনের হিসাব বাড়ছিল। ঘুমিয়ে কাটত শিশুটির বেশির ভাগ সময়। আজ শুক্রবার সকালে পাশের তিন তলা বাড়ির ছাদ থেকে ছুটে আসা ইটের আধলাটি যখন তার মুখে পড়ে, তখনো সে খালার কোলে ঘুমিয়ে ছিল। সেই ঘুম আর ভাঙেনি। নাগরিক জীবনের অনাগরিকসুলভ বিশৃঙ্খলা, বিত্তের ফারাক আর বড়দের দায়িত্ববোধের প্রতি এক দলা প্রশ্ন ছুড়ে সে চলে গেছে চিরতরে।
বাবা-মা তার নাম রেখেছিলেন আব্দুল্লাহ। নামের আগে পরে কি হবে—তা ঠিক করার সময় পাননি তাঁরা। শিশুটির মৃত্যুর কারণ যে ইটের আধলা, সেটির পেছনেও রয়েছে আরও দুই শিশু। ছাদের ওপর থেকে ‘খেলাচ্ছলে’ ওই শিশু দুটি ইটের আধলাটি ফেলে দিয়েছিল। তাদের একজনের বয়স সাড়ে তিন বছর, আরেকজনের দুই।
আব্দুল্লাহর মৃত্যুর জন্য তবে কি কেউ দায়ী নয়? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নগর জীবনের এক নিত্যদিনের সংকটের সন্ধান মিলল। তার আগে জেনে নেওয়া যাক আব্দুল্লাহর পরিবারের পরিচয় ও মর্মান্তিক ঘটনাটির বর্ণনা। আব্দুল্লাহর বাবা কবির হোসেন একজন গাড়িচালক। বরিশালের মুলাদী উপজেলার বাউতলা গ্রামে তাঁদের বাড়ি। পরিবার নিয়ে জোনাকি রোডের জীর্ণ এই বাড়িতে তিনি থাকেন গত ১১ বছর ধরে। এখানেই আবদুল্লাহসহ তাঁর তিন সন্তানের জন্ম হয়েছে। দেড় বছর আগে অসুস্থ হয়ে এখানেই মারা যায় কবিরের বড় মেয়ে আনিলা (১১)। আজ শুক্রবার আব্দুল্লাহ মারা যাওয়ার পর এখন তাঁর কোলে রয়েছে কেবল নয় বছরের মেয়ে লামিয়া। অথচ সেই কোলে আজ আব্দুল্লাহরও থাকার কথা ছিল!
পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আব্দুল্লাহর জন্মের পরই তার জন্ডিস ধরা পড়ে। এ কারণে নয় দিন হাসপাতালে থাকার পর গত শনিবার তাকে বাসায় নিয়ে আসেন বাবা-মা। মা লাইজু বেগম এখনো অস্ত্রোপচারের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কিশোরী খালা মোছা. তামিম ভাগনের দেখাশোনা করছিলেন। শুক্রবার সকালে রোদ পোহানোর জন্য আব্দুল্লাহকে নিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন ঘরের সামনের এক চিলতে বারান্দার মতো জায়গায়।
তামিম প্রথম আলোকে বলেন, ঘুমন্ত আব্দুল্লাহকে কোলে নিয়ে শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমন সময় ওপর থেকে ইটের আধলাটি প্রথমে তাঁর মাথায় পড়ে। এতে তাঁর মাথা ফেটে যায়। এরপর ইটের টুকরাটি আব্দুল্লাহর মুখে লাগে। নিজের মাথার আঘাতের কারণে তিনি তখন আর আব্দুল্লাহকে ধরে রাখতে পারেননি। কোল থেকে মেঝেতে পড়ে যায় ১৬ দিনের শিশুটি। ইটের আঘাত বা নিচে পড়ে যাওয়া কোনোটাতেই আব্দুল্লাহ কোনো শব্দ করেনি। একেবারেই নিশ্চুপ ছিল।
প্রতিবেশীরা জানান, আব্দুল্লাহকে প্রথমে আগারগাঁও শিশু হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে যেতে বলা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছানোর পর ডাক্তাররা জানান, শিশুটি মারা গেছে।
যে ঘরটিতে তামিমের সঙ্গে কথা হয়, সেখানেই বিছানার ওপর বসেছিলেন আব্দুল্লাহর মা লাইজু বেগম। একদৃষ্টিতে তিনি নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, কোনো কথা বলেননি। লাইজুদের কক্ষের আশপাশে আরও ২৪টি কক্ষ রয়েছে। এখানে যাঁরা থাকেন, তাঁরা সবাই নিম্নবিত্তের। কেউ রিকশা চালান, কেউ সিএনজি, আবার কেউবা ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করেন।
নুরুল আমিন নামে লাইজুদের এক প্রতিবেশী জানান, তিন তলা ওই বাড়ির ছাদ থেকে নিয়মিতই তাঁদের বাড়ির দিকে বিভিন্ন ধরনের নোংরা জিনিসপত্র ফেলা হয়। কখনো দেখা যায় কেউ দাঁত ব্রাশ করে মুখের ফেনা ফেলে দিচ্ছেন। বাচ্চারা ফল খেয়ে খোসাসহ ছোটখাটো নানা জিনিস প্রায়ই ছুড়ে মারে। এই বিষয়গুলো তাঁরা বাড়ির মালিককে বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি কোনো ব্যবস্থাই নেননি। অভিযোগের পর ছাদে এই ছোট্ট বাচ্চাদের ওঠাতে যদি তিনি বাধা দিতেন বা অভিভাবকেরা যদি তাদের দেখেশুনে রাখত, তবে হয়তো আব্দুল্লাহকে মরতে হতো না। নুরুল আমিনের কথাগুলোয় সায় দেন ওমর ফারুক নামের আরেক প্রতিবেশী। তাঁর জবানিতে, ‘ভাই, ওরা আমাদের মানুষই মনে করে না।’
ইটের টুকরো ছুড়ে মারা বাচ্চা দুটির বাবা শফিকুর রহমান একটি বায়িং হাউসে কাজ করেন। তাঁর দাবি, সকালে তিনি হঠাৎ লক্ষ্য করেন যে, তাঁর দুই মেয়ে ঘরে নেই। তাদের খুঁজতে তিনি যখন বাসার নিচে পৌঁছান, দেখেন গেট বন্ধ। ঠিক তখনই আশপাশের মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে তিনি ধরে নেন ছাদ থেকে তাঁর মেয়ে হয়তো নিচে পড়ে গেছে। ওপরে উঠে তিনি বাচ্চাদের ঠিকঠাক দেখতে পান। কিন্তু নিচে তাকিয়ে দেখেন, একটি শিশুকে নিয়ে সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে।
অভিযোগের পর ব্যবস্থা নিয়েছিলেন কিনা—এমন প্রশ্নের জবাব চাইলে সেই তিন তলা বাড়ির মালিক মিলি বেগম প্রথমেই জানান, তিনি ও তার পরিবার সরকার দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মিলি বেগমের দাবি, ব্যবস্থা তিনি নিয়েছিলেন। ছাদের গেট বন্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু শফিকুর রহমানের মায়ের ডায়াবেটিস রয়েছে বলে তাঁকে হাঁটাচলা করানোর জন্য ছাদের চাবি দিয়েছিলেন। মিলি বলছেন, এই অবস্থায় শিশু দুটিকে দেখে রাখার দায়িত্ব শফিকুরের পরিবারেরই ছিল।
মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দাদন ফকির প্রথম আলোকে বলেন, এটি একটি দুর্ঘটনা। সাত বছরের নিচে কোনো শিশু যদি কোনো অপরাধ করে, তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না। তাই এখানে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। প্রতিবেশীদের অভিযোগের পরও বাড়িওয়ালা কোনো ব্যবস্থা নেননি—এমন অভিযোগের বিষয়ে দাদন ফকির বলেন, এ বিষয়ে তাঁদের সতর্ক করে দেওয়া হবে।
আব্দুল্লাহর বাবা কবির হোসেনও জানিয়ে দেন, ছেলেকে তিনি আর ফিরে পাবেন না। তাই কারও বিরুদ্ধে তাঁর কোনো অভিযোগও নেই।
কবির যখন এই কথাটি বলছিলেন, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। যে জায়গাটিতে আব্দুল্লাহর ওপর ইটের টুকরাটি পড়েছিল, সেখানেই আব্দুল্লাহর গোসল করানো হয়েছে। মা লাইজু বেগমকে কাছে শেষবারের মতো যখন আব্দুল্লাহকে নিয়ে আসা হয়, তখন তিনি হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। একে-ওকে জড়িয়ে তিনি বারবার শুধু একটি কথাই বলছিলেন—‘হায় আল্লাহ, আমার লগেই কেন এমন হইল।’