‘সড়ক দুর্ঘটনা দিন দিন হত্যাপর্যায়ে চলে যাচ্ছে, যা বলা বোধ হয় ভুল নয়। অদক্ষ গাড়িচালক, বেপরোয়াভাবে বাস চালানো, গাড়ি চলাচলের অযোগ্য রাস্তা ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণে এই দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। সড়কে প্রতিদিন এত মানুষের মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা, নাকি হত্যা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সর্বসাধারণের মনে।’
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইদুর রহমান পায়েল হত্যা মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলা হয়েছে। পায়েল হত্যা মামলায় বাসচালকসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১–এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান। আজ রোববার এই রায় ঘোষণা করেন আদালত।
রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামি হলেন হানিফ পরিবহনের বাসচালক জামাল হোসেন, চালকের সহকারী ফয়সাল হোসেন ও সুপারভাইজার মো. জনি। সড়ক দুর্ঘটনা ক্রমে নিত্যদিনের সাধারণ ঘটনা হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আদালত। রায়ে বলা হয়, প্রতিটি সড়ক যেন হয়ে উঠেছে মৃত্যুফাঁদ। সড়ক দুর্ঘটনা তো ঘটছেই, মারা যাচ্ছে সব বয়সী মানুষ। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পথচারীও রেহাই পাচ্ছে না বেপরোয়া বাসচালকদের হাতে। সড়ক যোগাযোগমাধ্যম এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। দিনে দিনে সড়কে দীর্ঘায়িত হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। কোনোভাবেই এই মৃত্যুর মিছিল থামছে না।
সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিসংখ্যান তুলে ধরে আদালত বলেছেন, ‘তাহলে আর কবে আমরা সজাগ হব। সড়কে মৃত্যু আমাদের জন্য যদি সচেতন না করে, তাহলে আর কবে সচেতন করবে? নিহত ছাত্র সাইদুর রহমান পায়েল মেধাবী ছাত্র ছিলেন। উচ্চশিক্ষা নিয়ে নিজের ক্যারিয়ার গড়ে দেশ ও জাতির সেবায় আত্মনিয়োগের জন্য যখন নিজেকে তিনি প্রস্তুত করেছিলেন, সেই মুহূর্তে বাসচালক, সুপারভাইজার ও চালকের সহকারীর নির্মমতার শিকার হয়ে তাঁকে অকালেই প্রাণ দিতে হলো। তাঁর মৃত্যুতে তাঁর পরিবার হতাশায় নিমজ্জিত।’
সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর জন্য আদালত চারটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। প্রথম পর্যবেক্ষণ হলো গাড়ি চালাতে দেওয়ার আগে চালক, সুপারভাইজার এবং চালকের সহকারী মাদক গ্রহণ করেছেন কি না, সে জন্য তাঁদের প্রত্যেককেই ডোপ টেস্ট করাতে হবে।
দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণ হলো গাড়ির চালক, সুপারভাইজার এবং চালকের সহকারীরা প্রায় যাত্রীদের সঙ্গে কর্কশ ও অভদ্র আচরণ করেন। গাড়ির চালক সুপারভাইজার এবং চালকের সহকারী অবশ্যই যাত্রীদের সঙ্গে নম্র ও ভদ্র আচরণ করতে হবে। চালকসহ অন্যদের গাড়ি চালানোর বিষয় এবং যাত্রীদের সঙ্গে আচরণসংক্রান্ত কাউন্সেলিং বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
তৃতীয় পর্যবেক্ষণটি হলো মহাসড়কের প্রতি তিন কিলোমিটার পরপর গাড়ির চালক চালকের সহকারী এবং সুপারভাইজার এবং যাত্রী সাধারণের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক আধুনিক বাথরুম স্থাপন করতে হবে। এ জন্য বাসমালিকদের সরকারের সড়ক বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে সরকারের নির্ধারিত হারে মাসিক চাঁদা প্রদান করতে হবে।
আজ আদালতের দেওয়া চতুর্থ পর্যবেক্ষণ হলো ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসি ক্যামেরা) মাধ্যমে মহাসড়কে যান চলাচলের ওপর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
পায়েল হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে আদালত বলেছেন, পরস্পর যোগসাজশে আসামিরা পায়েলকে হত্যা করে লাশ গুম করার জন্য ভাটেরচর সেতু থেকে ফুলদী নদীতে ফেলে দেন। গোপন তদন্তে প্রকাশ পায় যে তখনো পায়েল বেঁচে ছিলেন।
ঘটনার বিষয়ে কোনো যাত্রী জানার আগেই আসামিরা বাসটি চালিয়ে ঢাকার দিকে চলে যান। ময়নাতদন্তে পরিষ্কার হয় যে নিহত পায়েল মারা গেছেন পানিতে ডুবে। লাশ গুম করার জন্যই আসামিরা পায়েলকে নদীতে ফেলে দেন।