ডান পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসেন কাবিরুন নাহার। মৌলভীবাজার জেলার বাসিন্দা মধ্যবয়সী এই নারী ছয় মাস আগে সৌদি আরবে যান। তাঁর আশা ছিল, সেখানে থেকে কাজ করে সংসারের ভাগ্য ফেরাবেন। কিন্তু তিনি দেশে ফিরলেন ভাঙা পা নিয়ে। কাবিরুনের মতোই চাঁদপুরের হোসনে আরাও সৌদি আরব যাওয়ার মাত্র পাঁচ মাস পরই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। বিরূপ পরিবেশ, খাবারের সমস্যার সঙ্গে কথায় কথায় গৃহকর্তার মারধরের কারণে টিকতে পারেননি তিনি। অথচ চুক্তি অনুযায়ী তাঁর দুই বছর সৌদি আরবে থাকার কথা ছিল।
ওই দুই নারীর সঙ্গে ফিরে এসেছেন লালমনিরহাটের শিরিনা বেগম, নাটোরের রেবেকা খাতুন, ঢাকার সেতু বেগম, গাজীপুরের নাসিমা আক্তারসহ ১৮ জন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে আমিরাত এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে সৌদি আরব থেকে তাঁরা দেশে ফেরেন। নির্যাতনে টিকতে না পেরে তাঁরা সবাই আশ্রয় নিয়েছিলেন সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের সেফহোমে (নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র)। দেশে ফেরার পর তাঁদের তিনজনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা সবাই সেখানে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন।
দেশে ফেরা প্রবাসী নারীদের পুনর্বাসনের কাজ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রাম। তারা বলছে, সৌদিতে গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়ে মালিকের হাতে নির্যাতিত হয়ে দেশে ফেরার ঘটনা থামছে না। গত সাড়ে আট মাসে দেশে ফিরেছেন ৮৫০ নারী। এর মধ্যে গত মাসে এক দিনেই ফিরেছেন ১০৯ জন নারী। তাঁদের অনেকে সেখানে শারীরিক-মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর আগের বছর ফিরেছেন ১ হাজার ৩৫৩ জন নারী। অনেকে ভয়াবহ যৌন নিপীড়নের শিকার হন সেখানে।
তবে ফিরে আসা কর্মীদের সব অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেন বেসরকারি খাতে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত করা হলে প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে।
>গতকাল ফিরেছেন আরও ১৮ নারী গৃহকর্মী
সাড়ে আট মাসে ফিরেছেন ৮৫০ নারী
গত বছর ফিরেছেন ১ হাজার ৩৫৩ নারী
সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে প্রবাসী মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ২ হাজার ২২২ নারী গৃহকর্মী দেশে ফিরেছেন। সৌদি দূতাবাসের শ্রম বিভাগের কাউন্সেলর আমিনুল ইসলাম গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আসলে কাজের চাপ, খাবারের সমস্যা, আবহাওয়া, ভাষা ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে অনেক নারী কর্মী সেখানে থাকতে চান না। তাঁরা যে বাসায় কাজের জন্য যান, সেখান থেকে পালিয়ে সেফহোমে চলে আসেন। তবে আগের চেয়ে এই প্রবণতা অনেকটা কমেছে।
নির্যাতনের অভিযোগে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিলে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সৌদি আরব। এরপর থেকে গত জুলাই পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ নারী কর্মী গেছেন সৌদি আরবে। দুই বছরের চুক্তিতে যাওয়া নারী গৃহকর্মীরা মাসে বেতন পান সৌদি মুদ্রায় ৮০০ রিয়াল (প্রায় ১৭ হাজার টাকা)। গৃহকর্মীরা বিনা খরচে সৌদি আরবে যেতে পারেন।
নির্যাতনের অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে নারীদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয় বলে জানান জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক (কর্মসংস্থান) ডি এম আতিকুর রহমান। তিনি বলেন, নির্যাতনসহ নানা কারণে এ বছর ফিরে আসা ২৬০ নারীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষতিপূরণের টাকা সংশ্লিষ্ট এজেন্সির কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে। ওই নারীরা সব মিলিয়ে ৮০ থেকে ৮৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। তিনি বলেন, সৌদি আরবে যাওয়া নারী গৃহকর্মীরা যাতে কোনো সমস্যায় না পড়েন, সে জন্য তদারকি বাড়ানো হয়েছে।
অভিবাসন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সৌদিতে নারী কর্মী পাঠানোর আগে এক মাসের প্রশিক্ষণ (ভাষা, কাজের ধরন, আবহাওয়া পরিস্থিতি) বাধ্যতামূলক থাকলেও তা মানা হয় না। গৃহকর্মী খাতে নারীদের না পাঠিয়ে অন্য কাজে পাঠানোর চেষ্টা করা উচিত বলে মনে করেন তাঁরা।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নারীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত না করে সৌদি আরব কেন, কোনো দেশেই পাঠানো ঠিক নয়। নারীদের কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারের নিয়মিত নজরদারি থাকতে হবে। না হলে কোনো কিছু করেই লাভ হবে না।