সেলিম খানের বালু উত্তোলন বন্ধই থাকছে

চাঁদপুর সদর ও হাইমচর উপজেলার ২১টি মৌজায় অবস্থিত মেঘনার ডুবোচর থেকে বালু উত্তোলনে সেলিম খানকে অনুমতি দিতে চার বছর আগে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, তা বাতিল করেছেন আপিল বিভাগ।

আজ রোববার প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।

এর ফলে ওই ২১ মৌজায় সেলিম খানের বালু উত্তোলন বন্ধই থাকছে বলে জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান।

চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান। তাঁর করা রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে ‘প্রকৃত অর্থে সহযোগিতায়’ চাঁদপুরের ২১টি মৌজায় অবস্থিত মেঘনার ডুবোচর থেকে ৮৬ দশমিক ৩০ কিউবিক মিটার (৩০ কোটি ৪৮ লাখ ঘনফুট) বালু তাঁকে উত্তোলনে অনুমতি দিতে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকসহ বিবাদীদের নির্দেশ দেওয়া হয়।

রায়ের চার বছর পর গত মার্চে রাষ্ট্রপক্ষ লিভ টু আপিল (আপিল করার অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে, যা ৪ এপ্রিল চেম্বার আদালতে শুনানির জন্য ওঠে। সেদিন শুনানি নিয়ে চেম্বার বিচারপতি হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে রাষ্ট্রপক্ষের করা লিভ টু আপিল শুনানির জন্য আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠান। এর ধারাবাহিকতায় শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি করে ওই সিদ্ধান্ত দেন।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান। অন্যদিকে, সেলিম খানের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি।

নথিপত্রে দেখা যায়, মেঘনা নদীর চাঁদপুর ও হাইমচর উপজেলায় অবস্থিত ২১টি মৌজায় জনস্বার্থে নিজ খরচে সেলিম খান হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে নির্দেশনা চেয়ে ২০১৫ সালে রিট করেন। নৌপথ সচল করার কথা বলে রিটটি করা হয়েছিল। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৯ জুলাই হাইকোর্ট রুল দেন। এর ধারাবাহিকতায় সেলিম খানের করা এক আবেদনের শুনানি নিয়ে ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর হাইকোর্ট ৩০ দিনের মধ্যে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ প্রতিবেদন পেতে রিট আবেদনকারীর (সেলিম খান) কাছে জমা দিতে বিবাদীদের অনুমতি দিতে নির্দেশ দেন।

রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে রুল নিষ্পত্তি করে ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল হাইকোর্ট রায় দেন। হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারির চিঠি উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, এতে প্রতীয়মান হয় যে ওই মৌজাগুলোয় পর্যাপ্ত বালু বা মাটি রয়েছে এবং তা তুলতে কোনো বাধা নেই। আপত্তি জানিয়ে বিবাদীদের (ভূমিসচিব, নৌপরিবহনসচিব, বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক ও হাইড্রোগ্রাফিক বিভাগের পরিচালকের পক্ষ থেকে কোনো জবাবও (হলফনামা) দায়ের করা হয়নি, যাতে বিষয়টি (বালু থাকা) বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।

উল্লেখ্য, হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের মাধ্যমে নদীর তলদেশে কোথায় কত দূরত্বে মাটি রয়েছে, তা আধুনিক পদ্ধতিতে চিহ্নিত করা বা এর মানচিত্র তৈরি করা হয়। ডুবোচর কাটতে হলে প্রথমে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে হয়।

মেঘনায় বালু উত্তোলনের কারণে নদীর তীর ভেঙে পড়া ও পরিবেশঝুঁকি নিয়ে ২ মার্চ প্রথম আলোয় ‘পদ্মা-মেঘনার সর্বনাশ: “বালুখেকো” চেয়ারম্যান তিনি’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা বলছেন, মেঘনায় নির্বিচার বালু তোলার কারণে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের কয়েকটি স্থান দেবে গেছে। ভেঙে পড়ছে নদীর তীরও। জাতীয় মাছ ইলিশের প্রজননও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অন্যদিকে, নদী থেকে তোলা বালু বিক্রি করে ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের আয় হচ্ছে মাসে প্রায় ৩০ কোটি টাকা।

এরপর হাইকোর্টের দেওয়া ওই রায় স্থগিত চেয়ে গত ১৫ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় লিভ টু আপিল করে, যা আজ আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হলো।

লিভ টু আপিলে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনের বালুমহাল ঘোষণা ও বিলুপ্তকরণ, বালুমহাল ইজারা প্রদান এবং ইজারা ব্যতীত বালুমহাল থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন ও রাজস্ব আদায় নিষিদ্ধসংক্রান্ত কয়েকটি বিধান উল্লেখ করা হয়।

লিভ টু আপিলে বলা হয়, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন অনুসারে কোনো নদী থেকে বালু উত্তোলনের জন্য হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ প্রতিবেদনই যে একক ভিত্তি নয়, তা হাইকোর্ট বিভাগ উপলব্ধি করতে পারেননি। বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন অনুসারে, পরিবেশ, পাহাড়ধস, ভূমিধস অথবা নদী বা খালের পানির স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন, সরকারি স্থাপনা (যথা ব্রিজ, কালভার্ট, রাস্তাঘাট, ফেরিঘাট, হাটবাজার, চা-বাগান, নদীর বাঁধ ইত্যাদি) এবং আবাসিক এলাকার কোনো ক্ষতি হবে কি না, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতামত গ্রহণ করবেন জেলা প্রশাসক। এ ছাড়া কোনো বালুমহালে উত্তোলনযোগ্য বালু বা মাটি না থাকলে বা বালু বা মাটি উত্তোলন করার কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিনষ্ট বা সরকারি বা বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত বা জনস্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে ওই বালুমহাল বিলুপ্ত ঘোষণা করার প্রস্তাব পাঠাতে পারবেন জেলা প্রশাসক।

লিভ টু আপিলে বলা হয়, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে ডুবোচরের বালু উত্তোলনের বিষয়ে কোনো ধরনের মূল্যায়ন হয়নি। এমনকি রিটে উল্লেখিত মৌজাগুলো বিভাগীয় কমিশনার বালুমহাল হিসেবেও ঘোষণা করেননি। তাই হাইকোর্ট বিভাগ বিবাদীকে (সেলিম খান) বালু উত্তোলনের অনুমতি দিতে যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা বাতিলযোগ্য