২৪ ডিসেম্বর ২০১৬। শীতের ভোর। তখনো আলো ফোটেনি। অন্ধকারেই বেজে উঠল ফোন। প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ ফোন করেছেন। জানালেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উত্তরার আশকোনায় একটা ‘জঙ্গিবাড়ি’ ঘিরে রেখেছে। ঘটনাস্থলে দ্রুত যেতে হবে। তখনই কথা বললাম প্রধান ফটোসাংবাদিক জিয়া ইসলামের সঙ্গে। ফিচারের জ্যেষ্ঠ ফটোসাংবাদিক খালেদ সরকার থাকেন উত্তরায়। তাই তাঁকে বললাম, ‘জঙ্গিবাড়ির দিকে আগান, আমি আসছি।’ ঘটনাস্থলে পৌঁছেই ছবি তুলতে থাকলাম, করলাম ভিডিও। সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিতে লাগলাম প্রথম আলোর অনলাইনে।
‘জঙ্গিবাড়ি’র নাম ‘সূর্যভিলা’! সেই বাড়ির আশপাশে কিছু দেখার জো নেই। চারদিকে কেবলই বাড়িঘর। একটা গলি দিয়ে এগোনো যায়, সেখানে আবার পুলিশের পাহারা। খালেদ সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করি, কী করা যায়? তিনি আমাকে একটা বাড়ির তিনতলায় নিয়ে গেলেন। সেখান থেকে সূর্যভিলা দেখা যায়। কিন্তু ছবি তোলার জন্য অবস্থানটা আমার ঠিক পছন্দ হলো না।
অন্য একটা একতলা বাড়ির ছাদে গেলাম। সেখান থেকে সব স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযানে নামলে সেখানে আর থাকতে দেবে না। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চায়ের দোকানে গেলাম। চা খাই আর জানার চেষ্টা করি কোন বাড়ির ছাদ থেকে সবকিছু ভালোভাবে দেখা যাবে। জানতে পারি সূর্যভিলার বাসিন্দাদের ধরনধারণ। অল্পবয়সী একটা ছেলে, কয়েকজন নারী থাকে সেখানে, এরাই সন্দেহভাজন। এর মধ্যে চায়ের দোকানে পরিচয় হলো একটা বাড়ির তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে। তিনিই প্রস্তাব দিলেন তাঁদের বাড়ির ছাদে যেতে। সেখান থেকে নাকি সব দেখা যাবে। শর্ত দিলেন, বাইরে বের হওয়া যাবে না। এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেও না! প্রস্তাবে রাজি হলাম।
বাড়ির ছাদে উঠে দেখি, সব একদম চোখের সামনেই ঘটছে। অভিযান শুরু হবে যেকোনো মুহূর্তে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃষ্টিসীমার কিছুটা দূরে আমার অবস্থান। ঘটনাস্থলের ওপর নজর বুলিয়ে বুঝতে পারলাম, জায়গাটা থেকে টেলিলেন্সে এমন ছবি পাওয়া সম্ভব যা অন্য কেউ পাবে না। কাজ করতে হবে ছাদের সামনে থাকা পেয়ারাগাছের ফাঁক দিয়ে, লেন্স বসিয়ে। তা-ই করলাম। সেখান থেকে কয়েকটা ছবি ও ভিডিও পাঠালাম প্রথম আলো অনলাইনে।
সময় গড়াতে থাকে, র্যাবের সদস্যরা এবাড়ি ওবাড়ির আশপাশ দিয়ে ভেতরের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছেন। দুপুরের দিকে বাড়ির ওপরতলার এক বয়সী নারীকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে নামিয়ে নিয়ে আসতে দেখলাম। সামনের সারিতে সোয়াটের সদস্যরা, পেছনে র্যাব এবং পুলিশের সতর্ক দৃষ্টি। নিচতলায় একটা দরজায় বাঁশ দিয়ে ধাক্কা দিলেন সোয়াটের সদস্যরা। কোনো সাড়া নেই। ভেতর থেকে সন্দেহভাজনদের বেরিয়ে আসার সময় দিলেন তাঁরা।
ভেতরে গ্রেনেডের শব্দ ও ধোঁয়া দেখতে পেলাম একসময়। তার কিছুক্ষণ পরই সোয়াটের সদস্যরা বিশেষ একধরনের ডালা সামনে রেখে বাড়ির প্রধান ফটকের দিকে এগিয়ে গেলেন। বাড়ির প্রধান ফটকের পাশের দেয়ালের ইটের ফাঁকা অংশে বন্দুক ধরে সারিবদ্ধভাবে অবস্থান নিলেন তাঁরা। ভেতরে থাকা মানুষদের ‘পাঁচ মিনিটের’ মধ্যে বেরিয়ে আসতে বলা হলো হাতমাইকে। দুই মিনিট যেতেই নিচতলার দরজাটি খুলে গেল। সামনে দুপুরের উজ্জ্বল আলোতে নির্মাণাধীন বাড়ির ইটের সারি, পেছনে নিচতলার দরজার সামনে জমাট বাঁধা অন্ধকার। ক্যামেরায় এক্সপোজার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ল। সময় খুব কম এবং প্রতিটা মুহূর্তের ছবি তুলছি আমি। এর মধ্যেই দেখলাম, সঙ্গে একটা মেয়েশিশুকে নিয়ে এক নারী বেরিয়ে আসছেন, পরনে বোরকা। প্রধান ফটকের দিকে আসতেই থমকে দাঁড়ালেন। তাঁকে থেমে যেতে দেখে শিশুটি ঘুরে তাকাল। একটা হাত কোমরে নিলেন সেই নারী। মুহূর্তের মধ্যে শিশুটিকে ধাক্কা দিলেন একদিকে। তার পরপরই ফাটালেন বোমা! চোখের পলকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তাঁর দেহ! আমার ক্যামেরায় বন্দী হলো সব দৃশ্য। আহত অবস্থায় শিশুটিকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। পরে জানতে পারলাম, শিশুটি ছিল আত্মঘাতী সেই নারীর মেয়ে।
২০১৭ সালের ওয়ার্ল্ড ফটো কনটেস্টে আমার তোলা সেই ছবিটা শেষ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায়। তবে সেই ছবির দৃশ্য এখনো মনে পড়ে আমার। ‘সূর্যভিলা’য় সেদিন কী ভীষণ আঁধারই না নেমে এসেছিল!