সবচেয়ে বেশি ৫১টি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের ৯ জেলার সীমান্তে। এসব জেলার সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের স্থলসীমা রয়েছে।
দেশের সীমান্তবর্তী ১৯ জেলার ৯৫টি পয়েন্ট দিয়ে সবচেয়ে বেশি মাদক আসছে। এসব পয়েন্টকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।
মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসে প্রকাশিত ডিএনসির বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ২৬ জুন দিবসটি পালিত হয়।
দেশের এই ১৯ জেলা ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তে পড়েছে। ডিএনসির প্রতিবেদনে এসব জেলাকে পশ্চিমাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চল—এই চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ৫১টি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে পশ্চিমাঞ্চলের ৯ জেলায়। এসব জেলার সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের স্থলসীমান্ত রয়েছে।
প্রতিবেদনে দক্ষিণাঞ্চলের জেলা কক্সবাজার ও বান্দরবান দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচারের ১৫টি রুট চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, এসব রুট দুর্গম এলাকায় হওয়ায় ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
ডিএনসির প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের পশ্চিমাঞ্চলের নওগাঁ জেলার সীমান্তবর্তী সাতটি নতুন রুট দিয়ে ফেনসিডিল আসছে। সাতক্ষীরার সাতটি পয়েন্ট দিয়ে আসছে ফেনসিডিল ও ইয়াবা। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট ও দিনাজপুরের ২৪টি পয়েন্ট দিয়ে ফেনসিডিলের পাশাপাশি হেরোইন আসছে। এ ছাড়া যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের ১৩টি পয়েন্ট দিয়ে দেশে ফেনসিডিল ঢুকছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের ৮ জেলার ২৯টি পয়েন্ট দিয়ে ফেনসিডিল ও গাঁজা আসছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লার নয়টি পয়েন্ট এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছয়টি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে।
মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ মাদক ব্যবসার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বিজিবির সার্বক্ষণিক টহল, তল্লাশি ও নজরদারির কারণে সীমান্তে বিপুল পরিমাণে মাদক উদ্ধার হচ্ছে।লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান, পরিচালক (অপারেশন), বিজিবি
মাদক ও চোরাচালান প্রতিরোধসহ সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ মাদক ব্যবসার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বিজিবির সার্বক্ষণিক টহল, তল্লাশি ও নজরদারির কারণে সীমান্তে বিপুল পরিমাণে মাদক উদ্ধার হচ্ছে। মাঠপর্যায়ের পাচারকারীরা গ্রেপ্তার হলেও মূল হোতাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে মাদক পাচার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
কক্সবাজার সীমান্তে মাদক পাচার রোধে সার্ভেল্যান্স সিস্টেম স্থাপনের কার্যক্রম চলছে জানিয়ে ফয়জুর রহমান বলেন, দুর্গম সীমান্ত এলাকায় বিজিবি সদস্যদের নিরাপদে পৌঁছানো, দ্রুত অভিযান পরিচালনার জন্য দুটি আধুনিক হেলিকপ্টার সংযোজিত হয়েছে।
ডিএনসির নানা সীমাবদ্ধতার কারণে মাদক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির নানা সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, জনবল সংকট রয়েছে। মাদক শনাক্তে যন্ত্রপাতি, অপরাধীদের ব্যবহৃত মুঠোফোন ট্র্যাকিং এবং অপরাধ দমনে যানবাহনের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। কর্মকর্তারা নিরস্ত্র অবস্থায় মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেন। অনেক সময় মাদক কারবারিদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকায় সঠিকভাবে অভিযান পরিচালনা করা যায় না। প্রতিবেদনে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের পেশা ও প্রযুক্তিনির্ভর প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মাদকের চাহিদা, জোগান এবং ক্ষতি কমাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে সে অনুযায়ী কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে মাদক প্রতিরোধে সব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা কাজ করছি।’
ডিএনসির প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ইয়াবা উদ্ধার বেড়েছে ৪৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। গত বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৫ কোটি ৩০ লাখ ৭৩ হাজার ৬৬৫ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে। গত পাঁচ বছরে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ। ২০২০ সালে উদ্ধার করা ইয়াবার পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৮১ হাজার ১৭ পিস।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের শান ও কোচিন প্রদেশে কারখানা করে ইয়াবা উৎপাদন করা হয়। নানা কৌশলে এই মাদক বাংলাদেশে পাচার করা হয়। সে দেশ থেকে ইয়াবা পাচারে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হয়। মিয়ানমার সীমান্তে মাদক পাচারের ১৫টি পয়েন্টের মধ্যে ১০টি কক্সবাজার সীমান্তে ও ৫টি বান্দরবান সীমান্তে।
ডিএনসির কর্মকর্তারা বলেন, ইয়াবা ও আইস প্রতিরোধে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। তাদের সঙ্গে এ পর্যন্ত চারটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। মিয়ানমার অংশে ইয়াবার গোপন কারখানার তালিকা হস্তান্তর করা হলেও তারা সেগুলো বন্ধে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। মাদক নিয়ন্ত্রণে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৯৪ সালে চুক্তি হয়। ওই চুক্তির আওতায় ২০১১ সালে ইয়াঙ্গুনে প্রথম দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। এরপর ২০১৫ সালে ঢাকায় দ্বিতীয়, ২০১৭ সালে ইয়াঙ্গুনে তৃতীয় সভা হয়। করোনার কারণে ২০২০ সালে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে সর্বশেষ সভা হয়। সর্বশেষ দুই বৈঠকের সম্মত কার্যবিবরণীতে স্বাক্ষর করেনি মিয়ানমার।