নিজেদের নেতা কর্মীদের নিয়ে সারা দেশে ‘রাবেতাতুল ওয়ায়েজীন’ নামক একটি সংগঠন তৈরি করেছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সেই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সংগঠনটি সারা দেশে ওয়াজ মাহফিল নিয়ন্ত্রণ করছে বলে দাবি পুলিশের।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম তাঁর কার্যালয়ে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদ সম্পর্কে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় এ কথা জানান।
যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম বলেন, ‘সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আয়োজকদের বাধ্য করা হচ্ছে হেফাজত নেতাদের বিভিন্ন ওয়াজে নেওয়ার জন্য। এর মাধ্যমে তাঁরা উগ্রবাদী বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করতে পারছে।’ তা ছাড়া মাদ্রাসার গরিব ছাত্রদের ব্যবহার করে হেফাজত নেতার বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। মাদ্রাসা দখলের মতো অপকর্ম ও অনেকের নারী বিলাসের মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনা ঘটেছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
সম্পত্তি নাশকতার বিরুদ্ধে হওয়া ১২টি মামলা এবং ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের ঘটনায় হওয়া ৫৩টিসহ মোট ৬৫টি মামলার তদন্ত করছে ডিবি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির বাংলাদেশে আগমনকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত হেফাজতের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের ১৪ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান ডিবির এই যুগ্ম কমিশনার। তিনি বলেন, ‘তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কোরআন হাদিস বোঝেন, জানেন এমন তদন্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে তিনটি দল গঠন করে দেওয়া হয়েছে। তদন্তে মূলত নাশকতার মূল উদ্দেশ্য কী, কারা করছে, কেন করছে, তা জনার চেষ্টা করছেন তারা।’
২০১৩ সালে সরকার পতনের অনেক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে হেফাজতের চক্রান্ত হয় উল্লেখ করে মাহবুব আলম বলেন, ‘হেফাজতে কাজে লাগিয়ে সরকার পতনের একটি অপচেষ্টা চালিয়েছিল। এ বছর আবার যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে যে নাশকতা হলো, সেখানে একই ধরনের আরেকটি চক্রান্ত হয়েছে। এটা তদন্তে অনেকটাই পরিষ্কার হয়েছে। সবচে বড় কথা হলো, হেফাজত নিজেদের অরাজনৈতিক দল বলছে। কিন্তু বাস্তব হলো তাদের অনেকেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।’
তিনি বলেন, অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতাই মনে করেন যে হেফাজত একমাত্র প্ল্যাটফর্ম যেটা ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে কাজে লাগতে পারে। মাদ্রাসার ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তাঁরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এমন ’অপচেষ্টা’ করছে বা নাশকতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার বলেন, অনেকেই তাদের অরাজনৈতিক চরিত্রটি বলছেন। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে হেফাজত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এগুলো তাদের জিজ্ঞাসাবাদ থেকে পেয়েছি। ২০১৩ সালে বাবুনগরী ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছিলেন। কিছুদিন আগে মুফতি ফখরুল জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানে পুলিশ এসব ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরেছে।
মাহবুব আলম বলেন, ‘প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেরই আলাদা আলাদা এজেন্ডা রয়েছে। সেই এজেন্ডাগুলো তারা বাস্তবায়ন করতে চায় হেফাজতকে দিয়ে। হেফাজত এমনই এক সংগঠন যার ডাকে মাদ্রাসার ছাত্রদের আনা ও ব্যাপক লোক সমাগম সম্ভব হয়।’
হেফাজত নেতারা কী চান, এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুব আলম বলেন, ‘তারা আসলে চান সরকার পতনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তান মডেল বানানোর পরিকল্পনা আছে।’
তা ছাড়া হেফাজতের মধ্যে বেশ কয়েকটি ভাগ আছে বলেও দাবি মাহবুবের। একটি পক্ষে উগ্রবাদের পক্ষে যাঁদের নাম জানার চেষ্টা চলছে। এ নিয়ে গ্রেপ্তারও অব্যাহত আছে। উগ্রবাদের সঙ্গে জড়িতরা সম্প্রতি যে নাশকতা করেছে সেগুলোর ভিডিও ফুটেজ, অডিও কথোপকথন এবং জিজ্ঞাসাবাদে যে তথ্যগুলো এসেছে সেগুলোর মাধ্যমে সাক্ষ্য-প্রমাণের চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।
হেফাজত নেতা মামুনুল হকের গোপন বিয়ের বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছে বলে জানান মাহবুব আলম। তিনি বলেন, প্রথম বিয়ে শরিয়ত বা আইনসম্মতভাবে হয়েছে। পরবর্তী যে দুটি বিয়ের কথা তিনি স্বীকার করেছেন, এ দুটি চুক্তিভিত্তিক বিয়ে। সেখানে কোনো কাবিননামা নেই। পরের বিয়ের চুক্তিগুলো হচ্ছে- স্ত্রী থাকবে কিন্তু স্ত্রীর কোনো মর্যাদা পাবে না। স্ত্রী মেলামেশা করতে পারবে কিন্তু সম্পর্কের কোনো অধিকার পাবে না। একি সঙ্গে কোনো দাবিদাওয়া বা সন্তান ধারণ করতেও পারবে না। এ ধরনের চুক্তি প্রচলিত আইনের পরিপন্থী বলে জানান মাহবুবুল আলম।
কোনো রাজনৈতিক দল ষড়যন্ত্র জড়িত এ বিষয়ে ডিবির যুগ্ম কমিশনার বলেন, ইসলামপন্থীর বাইরেও মূলধারার রাজনৈতিক দল আছে। তাঁদের সঙ্গে জমায়েত ইসলাম, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলেরও বেশ কিছু নেতার যোগসাজশ রয়েছে। ২০১৩ সালেও ছিল, চলতি বছরেও আছে।
মাহবুব আলম বলেন, ‘লন্ডন থেকে ওলামা দলের এক নেতা হেফাজত নেতাদের পক্ষে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা তৈরি করছেন। হেফাজতের নেতাদের এখানে নাকি হিন্দু লোকজন জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। কোরআন নাকি ফেলে দেওয়া হয়েছে টয়লেটে। মামুনুল হককে নাকি মারধর করা হচ্ছে- ইত্যাদি বিভিন্ন অপপ্রচার হচ্ছে। এই মিথ্যা অপপ্রচার তাদের কৌশলেরই অংশ। দেশেও জামায়াত শিবিরের সঙ্গে জড়িত অনেকেই এটা করছেন যারা ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন।’
সরকার পতনের বিষয়ে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে কী চুক্তি হয়েছে- এ প্রশ্নের উত্তরে ডিবি যুগ্ম কমিশনার বলেন, ‘এ ধরনের বিষয়টি এখনো পরিষ্কার হয়নি। তাদের সঙ্গে সর্বশেষ কোনো গোপন মিটিং হয়েছে, নাকি ২০১৩ সালের মিটিংয়ের ধারাবাহিকতায় তাঁরা কাজ করছেন, সেগুলোর বিষয়ে এখনো পূর্ণাঙ্গ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছেন, সবারই স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় এখানে রয়েছে। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ সারা দেশে যে নাশকতা হয়েছে এ বিষয়ে তার বলছেন, হেফাজত ছাড়াও আরও বহুলোক এখানে রয়েছে।’
হেফাজতের অর্থের জোগানদাতা কারা, এ বিষয়ে মাহবুব আলম বলেন, ‘তাঁরা (হেফাজত নেতারা) বলেছেন বাইরে থেকেই বেশির ভাগ অর্থ আসে। রাজনৈতিক দল থেকে এ সময় কোনো ফান্ড নেওয়া হয়েছে কি না, এ ধরনের কোনো বিষয় এখনো পাওয়া যায়নি।’
এবার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাইরে থেকে অর্থ এসেছে কিনা, সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখনো নিশ্চিত নই। অভিযান অব্যাহত থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত নাশকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং ইন্ধনদাতারা গ্রেপ্তার না হচ্ছে।’