সারে ওজনে কম এবং চাঁদাবাজির অভিযোগে ১৪ আগস্ট বিসিআইসির চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছে ডিলারদের সংগঠন বিএফএর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা
■ খোলাবাজারে এক কেজি ইউরিয়া সারের দাম ১৬ টাকা। এক বস্তা ৮০০ টাকা
সরকারি কারখানার সার কিনে ঠকছেন কৃষকেরা। দেশের একজন গরিব চাষি ৫০ কেজির এক বস্তা দানাদার ইউরিয়া সার কিনলে ওজনে এক থেকে আড়াই কেজি কম পাচ্ছেন। খোলাবাজারে এক কেজি ইউরিয়া সারের দাম ১৬ টাকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ও জামালপুরের যমুনা সার কারখানার বিরুদ্ধে সারের বস্তায় ওজনে কম দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
মূলত সার কারখানা দুটির পরিবেশক বা ডিলাররা ওজনে কম দেওয়ার অভিযোগ করে আসছিলেন। সম্প্রতি দুটি কারখানা থেকে বের হওয়া সারের ট্রাক থেকে বস্তা নামিয়ে এবং পরিবেশক ও খুচরা দোকানে বস্তার ওজন মেপে এই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। সার মাপার ভিডিও রয়েছে প্রথম আলোর কাছে।
আশুগঞ্জ সার কারখানা (আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড) নিজের উৎপাদিত ইউরিয়া সারেই ওজনে কম দিচ্ছে। অন্যদিকে যমুনার (যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড) নিজের উৎপাদিত সার নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। তবে তারা আমদানি করা যে সার পরিবেশকদের দেয়, সেখানে ওজনে কম পাওয়া গেছে।
শুধু ওজনে কম নয়, কারখানা দুটিতে সার নিতে গিয়ে ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হচ্ছে পরিবেশকদের। অভিযোগ আছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হয়।
আশুগঞ্জ ও যমুনা সার কারখানা শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) মালিকানাধীন। সংস্থাটির অধীনে মোট চারটি ইউরিয়া সার কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটিতে চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি বন্ধ রয়েছে। অন্যটি সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড। এটি অবশ্য চালু রয়েছে।
ওজনে কম দেওয়া এবং চাঁদা নেওয়ার অভিযোগে গত ১৪ আগস্ট বিসিআইসির চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক, আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছিল ডিলারদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা।
এ বিষয়ে বিসিআইসি বলছে, অতীতে সারে কম দেওয়ার অভিযোগ তারা পেত। সাম্প্রতিককালে পায়নি। এ বিষয়ে তারা কঠোর অবস্থান নিয়েছে। সংস্থাটির পরিচালক (বাণিজ্যিক) মো. আমিন উল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে বলা আছে যে ৫০০ গ্রাম সারও কম দেওয়া যাবে না। এ অভিযোগ আমরা খতিয়ে দেখব।’
জমির উর্বরতা শক্তি বাড়াতে কৃষকেরা ইউরিয়া সার ব্যবহার করেন। ধান, গমসহ প্রায় সব ধরনের ফসল চাষে দেশে এই সার ব্যবহার করেন কৃষকেরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহাজাদাপুর ইউনিয়নের কৃষক রাহুল ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, জমি চাষের জন্য প্রতি বছর ৫০ বস্তার মতো ইউরিয়া সার কিনতে হয় তাঁকে। অনেক দিন ধরেই তাঁর সন্দেহ হচ্ছিল বস্তায় এক থেকে দেড় কেজি সার কম থাকতে পারে। একবার বস্তার ওজনও করেছিলেন। প্রায় দুই কেজি সার কম থাকার কথা দোকানিকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। পরে তাঁর পরিচিত এক ডিলারকেও বস্তায় সার কম থাকার কথা বলেছিলেন।
‘আমাদের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে বলা আছে যে ৫০০ গ্রাম সারও কম দেওয়া যাবে না। এ অভিযোগ আমরা খতিয়ে দেখব।’মো. আমিন উল আহসান, সংস্থাটির পরিচালক (বাণিজ্যিক)
ওজনে কতটুকু কম
আশুগঞ্জ সার কারখানা থেকে সরবরাহ করা প্রতি ৫০ কেজির বস্তায় এক থেকে আড়াই কেজি সার কম দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন পরিবেশকেরা। এই কারখানা থেকে সারের বস্তা প্রথমে ট্রাকে করে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের নতুন ফেরিঘাট এলাকায় নিয়ে যান পরিবেশকেরা। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার সেখানে কথা হয় একাধিক পরিবেশকের সঙ্গে। তাঁদের অভিযোগের পর সত্যতা যাচাইয়ে ট্রাক থেকে নামিয়ে দুটি বস্তা মাপা হয়। দেখা যায়, বিসিআইসি লেখা ও আশুগঞ্জ সার কারখানার লোগোযুক্ত ৫০ কেজির একটি বস্তায় ৪৬ কেজি ৯৫০ গ্রাম এবং আরেকটিতে ৪৭ কেজি ৩৪০ গ্রাম দানাদার ইউরিয়া সার রয়েছে।
আশুগঞ্জ সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহাদাত হোসেন ওজনে কম থাকার একটি ব্যাখ্যা দেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বস্তায় সার ৫০ কেজির বেশি থাকে। দু-একটা বস্তায় হয়তো কম থাকে। পরিবেশকদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, কারখানায় সার মাপার যন্ত্রটি পুরোনো। মেরামত করে কাজ করতে হয়। তাই মাঝেমধ্যে কোনো বস্তায় বেশি, কোনোটায় কম যায়। তবে কমের পরিমাণ এক কেজির বেশি হয় না।
শাহাদাত হোসেন আরও বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানি। মাপার যন্ত্র মেরামত করতে বলেছি।’
অবশ্য পরিবেশকদের অভিযোগ, সব বস্তায়ই সার কম দেওয়া হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে কম পাওয়া যায়। শাহাদাত হোসেনের দাবির সত্যতা যাচাইয়ে গত শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের জগতবাজার এলাকার পুষ্প ট্রেডার্স, বাদল ট্রেডার্স, দাতা এন্টারপ্রাইজ ও রুহুল আমিন এন্টারপ্রাইজে গিয়ে সার মেপে এক থেকে দুই কেজি করে কম পাওয়া যায়। তবে কোথাও ৫০ কেজির বেশি পাওয়া যায়নি।
আশুগঞ্জ সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহাদাত হোসেন ওজনে কম থাকার একটি ব্যাখ্যা দেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বস্তায় সার ৫০ কেজির বেশি থাকে। দু-একটা বস্তায় হয়তো কম থাকে।
রুহুল আমিন এন্টারপ্রাইজের মালিক জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যা চলছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় অভিযোগ জানানো হয়েছে। সমাধান হয়নি।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা বলছে, আশুগঞ্জ সার কারখানা থেকে বছরে গড়ে প্রায় দেড় লাখ টন দানাদার ইউরিয়া সার সাত জেলায় সরবরাহ করা হয়। হিসাব করে দেখা গেছে, গড়ে দেড় কেজি করে কম দেওয়া হলে মোট কম পাওয়া যায় সাড়ে চার হাজার টন। যার দাম প্রায় ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
বিএফএর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখার সভাপতি জালাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন-চার বছর ধরেই ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে। কতবার যে লিখিত অভিযোগ করেছি। কোনো লাভ হয়নি।’
আশুগঞ্জ সার কারখানা থেকে উৎপাদিত ইউরিয়া সার চাঁদপুর, কুমিল্লা, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সরবরাহ করা হয়। কিছু যায় সিলেট ও হবিগঞ্জে। ওই সব এলাকার কৃষকেরা ওজনে কম পেয়ে ঠকছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কৃষকেরা বস্তা দরে সার কিনে থাকেন। তাঁরা কখনো বস্তায় কতটুকু ওজন, তা মাপেন না। বিএফএর জেলা শাখার সভাপতি জালাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বস্তায় কম থাকায় কৃষকেরা কম পান। যেসব দোকানি বস্তা খুলে খুচরা সার বিক্রি করেন, তাঁরাও ঠকেন।
কারখানায় বস্তা ভরার পর গুদামে ও দোকানে দীর্ঘ সময় রাখার কারণে সারের ওজন কমে কি না, তা জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল সরকারি আরেকটি সার কারখানার একজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, রেখে দেওয়ার কারণে ওজন কমে না।
দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যা চলছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় অভিযোগ জানানো হয়েছে। সমাধান হয়নি।জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া, রুহুল আমিন এন্টারপ্রাইজের মালিক
ঘাটতি যমুনায়ও
জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার যমুনা সার কারখানা থেকে উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলাসহ মোট ১৯ জেলায় সার সরবরাহ করা হয়। ওই কারখানা থেকে পরিবেশকদের দুই ধরনের ইউরিয়া সার দেওয়া হয়। একটি যমুনার নিজস্ব উৎপাদিত সার, যা নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই, ওজনও ঠিক থাকে। তবে আমদানি করা সারে ওজনে কম এবং নিম্নমানের সার দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
কারখানা সূত্র জানায়, খোলা আকাশের নিচে সার রাখার কারণে বৃষ্টিতে জমাট বেঁধে যায়। পরে ওই সার গুঁড়া করে পুনরায় বাজারজাত করা হয়। গত আগস্ট পর্যন্ত প্রতি ৯ টন যমুনার সারের সঙ্গে ৩ টন আমদানি করা যার নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। গত ২২ আগস্ট নষ্ট সার দেওয়ার অভিযোগে পরিবেশক সমিতি সার উত্তোলন বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর দুই টন করে আমদানি করা সার দেওয়ার নিয়ম করা হয়। অবশ্য বিসিআইসি বলছে, জমাট বাঁধলেও সারের গুণগত মান খারাপ হয় না। রং যদি পরিবর্তন হয়, তাহলে গুণগত মান খারাপ হয়ে গেছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
পরিবেশকদের সমস্যা হলো কৃষকেরা আমদানি করা সার নিতে চান না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবেশক প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি করা সার নিম্নমানের। আবার আমদানি করা সারের প্রতি বস্তায় ওজন ৪ থেকে ৫ কেজি কম থাকে।
পরিবেশকদের দাবির সত্যতা যাচাইয়ে গত শুক্রবার দুপুরে জামালপুর সদর উপজেলার নান্দিনা বাজারের তিনটি দোকানে আমদানি করা সার মেপে দেখা যায়, একটি দোকানে (মুসলিম উদ্দিনের দোকান) সারের বস্তায় সাড়ে তিন কেজি কম পাওয়া যায়।
মুসলিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন,‘আমদানি করা সার বিক্রি করে আমাদের তেমন একটা লাভ হয় না। এসব সার নিম্নমানের। কৃষক নিতে চায় না। আবার আমদানি করা সারের প্রতিটি বস্তায় ওজনে কম থাকে।’
পরিবেশকেরা গত ২২ আগস্ট সার উত্তোলন বন্ধ করে যে আন্দোলন করেছিলেন, তাতে কিছুদিন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
অবশ্য যমুনা সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুদীপ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারখানায় আমি নতুন যোগদান করেছি। এখনো অনেক বিষয়ে আমি অবগত নই।’ তবে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখবেন বলে জানান তিনি।
মুসলিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন,‘আমদানি করা সার বিক্রি করে আমাদের তেমন একটা লাভ হয় না। এসব সার নিম্নমানের। কৃষক নিতে চায় না। আবার আমদানি করা সারের প্রতিটি বস্তায় ওজনে কম থাকে।’
আশুগঞ্জে সারের ট্রাকে চাঁদা
কারখানার ৩ নম্বর ফটক থেকে সারের বস্তা মাথায় করে নৌকায় ওঠাতে (হেডলোড) বস্তাপ্রতি সাড়ে সাত থেকে আট টাকা নেন ঠিকাদার ও কারখানার শ্রমিকেরা। এ ছাড়া কারখানার আরেকটি ফটক দিয়ে সারের বস্তা ট্রাকে ওঠাতে প্রতি বস্তার জন্য এক টাকা দিতে হয় ঠিকাদারের শ্রমিকদের। যদিও বস্তা ওঠাতে কারখানা কর্তৃপক্ষ প্রতিটি ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের ৬০ পয়সা করে দেয়। ট্রাকের সিরিয়াল পেতে দিতে হয় ৫০ টাকা। বস্তা ট্রাকে ওঠাতে ঠিকাদার নিয়োগ দেয় কারখানা কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয় ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মিন্টু মিয়া বলেন, শ্রমিকদের উন্নয়নের জন্য ট্রাকের সিরিয়াল বাবদ ৫০ টাকা করে রাখা হয়। আবার সেখান থেকে ৫০ শতাংশ টাকা ট্রাক মালিক সমিতিকে দেওয়া হয়।
অবশ্য বড় সমস্যা হলো ট্রাক ভাড়া বেশি, যা নির্ধারিত হয় ট্রাকমালিক ও শ্রমিকদের ইচ্ছায়। আশুগঞ্জ সার কারখানা থেকে নতুন ফেরিঘাট পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তা পরিবহনে ট্রাক মালিক সমিতিকে ট্রাকপ্রতি ১ হাজার ৯০০ টাকা করে দিতে হয়। পরিবেশকেরা বলছেন, এ ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।
ট্রাক মালিক সমিতির আহ্বায়ক বাদল সরকার বলেন, সার পরিবহনে ট্রাকপ্রতি ১ হাজার ৯০০ টাকার মধ্যে ৪০০ টাকা ‘লোডিং’ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিতে হয়। কারণ জানতে চাইলে লোডিং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম এন রহমানের স্বত্বাধিকারী তারেকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবেশকেরা খুশি হয়ে শ্রমিকদের বকশিশ দেন। এতে আমার কিছু করার নেই। আমাকে তাঁরা জানানও না। বাকি অভিযোগ সত্য নয়।’
যমুনায় ঘাটে ঘাটে চাঁদা
কৃষকেরা যেহেতু আমদানি করা সার কিনতে আগ্রহী নন, সেহেতু পরিবেশকেরাও যেকোনো উপায়ে এই সার নেওয়া এড়াতে চান। যমুনার সারের সঙ্গে আমদানি করা সার নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু আমদানি করা সার না নিয়ে (প্রতি ৯ টন যমুনার সারের সঙ্গে ২ টন আমদানি করা সার নিতে হয়) যমুনার শুধু নিজস্ব সার নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয় কারখানাকে ঘিরে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেট। এ জন্য দিতে হয় ট্রাকপ্রতি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা।
গত ২৪ আগস্ট কারখানায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পরিবেশকদের জন্য বরাদ্দকৃত সার উত্তোলন করা হচ্ছে। আমদানি করা সারের বদলে শুধু যমুনার সার ট্রাকে তোলার বিষয়ে কারখানার উপসহকারী কারিগরি কর্মকর্তা আবুল কালাম বলেন, তারাকান্দি ট্রাক-ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি স্লিপ দেয়। পরে কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলেই শুধু এ কারখানায় উৎপাদিত সার দেওয়া হয়।
ট্রাক-ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির নেতা আশরাফুল আলম বলেন, ‘আমাদের স্লিপ দেখালেই কর্তৃপক্ষ শুধু কারখানায় উৎপাদিত সার দেবে কেন?’
যমুনা সার কারখানা ঘিরে পরিবেশকদের কাছ থেকে চারটি ক্ষেত্রে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। ট্রাক বের করার সময় বস্তাপ্রতি দেড় টাকা করে নেয় তারাকান্দি ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতি। ট্রাক ভাড়ার ১০ শতাংশ নেয় তারাকান্দি ট্রাক-ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি। তবে স্থানীয় ট্রাকের জন্য ছাড় আছে। কারখানায় ঢোকানোর জন্য ট্রাকপ্রতি ১২০ টাকা নেয় তারাকান্দি ট্রাক-ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান চালক শ্রমিক ইউনিয়ন এবং কারখানায় সার ট্রাকে ওঠাতে ট্রাকপ্রতি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা নেন কারখানা নিয়োজিত ঠিকাদারের শ্রমিকেরা। যদিও শ্রমিক নিয়োগ করা ঠিকাদারকে কারখানা কর্তৃপক্ষই মজুরি বাবদ টাকা দেয়।
পরিবেশকদের অভিযোগ, যমুনা সার কারখানাকে ঘিরে গড়ে ওঠা সংগঠনের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী তারাকান্দি ট্রাক-ট্যাংক লরি ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি। এ সমিতির নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন ওই সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম ওরফে মানিক। অন্য যেসব সংগঠন রয়েছে, সেগুলোও নিয়ন্ত্রণ করেন আশরাফুল ও তাঁর ঘনিষ্ঠ লোকজন। চাঁদা নেওয়াসহ সবকিছু তাঁরা করেন প্রকাশ্যে। সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের দু-তিনজন নেতা মিলে এসব টাকা খরচ করেন। প্রভাবশালীদের ভাগও দেন।
চাঁদা তোলার বিষয়টি অস্বীকার করেননি আশরাফুল আলমও। তবে তাঁর দাবি, এ টাকা তাঁর নেতৃত্বাধীন সমিতি নেয় না। এর ওপর তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণও নেই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে তারাকান্দি ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি নামে একটি সমিতি আছে। তারাই সারের বস্তাপ্রতি এক থেকে দেড় টাকা চাঁদা নেয়। এজেন্সির নেতারা সেই টাকা শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করেন।’
মালিক সমিতির নামে প্রতিটি ট্রাক থেকে ১০ শতাংশ হারে চাঁদা নেওয়ার বিষয়ে আশরাফুল বলেন, এ টাকা শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করে সমিতি। সার কারখানায় ২৮ বছর ধরে এ নিয়ম চলছে।
আর ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির সভাপতি মোজাম্মেল হক বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই।’
নাম না প্রকাশের শর্তে যমুনা সার কারখানার একজন কর্মকর্তা বলেন, কারখানা কর্তৃপক্ষ ওই সিন্ডিকেটের কাছে আসলেই অসহায়। কিছু বলতে গেলে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।
সারে ওজন কম দেওয়া এবং কারখানা থেকে সারের বস্তা ট্রাকে ওঠাতে ঘাটে ঘাটে চাঁদা দেওয়ার বিষয়টি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যাদের হাতেই ক্ষমতা আছে, তারাই মানুষকে হয়রানি করে। সারের বস্তায় ওজনে কম দেওয়া উদ্বেগজনক। কারণ, দেশের কৃষকেরা এমনিতেই তাঁদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না। আবার সারে ওজনে কম পেয়েও ঠকেন।
যাদের হাতেই ক্ষমতা আছে, তারাই মানুষকে হয়রানি করে। সারের বস্তায় ওজনে কম দেওয়া উদ্বেগজনক।ইফতেখারুজ্জামান, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক