আলোচিত জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান চিকিৎসক সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর জাতীয় পরিচয়পত্র ও আয়কর বিবরণী সনদ জালিয়াতির সঙ্গে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) দুই কর্মকর্তার যোগসাজশ পাওয়া গেছে। এ-সংক্রান্ত মামলার তদন্তে এই যোগসাজশ পাওয়ার কথা জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।
মামলার তদন্ত তদারককারী কর্মকর্তা ডিবির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাবরিনার বিরুদ্ধে করা জাতীয় পরিচয়পত্র ও আয়কর বিবরণী সনদ জালিয়াতির মামলার তদন্ত শেষ।
তদন্তে জালিয়াতির ঘটনায় ইসি ও ডিএসসিসির দুই কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তাঁদের এই মামলার অভিযোগপত্রে অন্তভুক্ত করা হবে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তারপর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে।’
করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা না করে ভুয়া ফলাফল দেওয়ার অভিযোগে ২০২০ সালের ১২ জুলাই সাবরিনাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সাবরিনা জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে কর্তৃপক্ষ।
একই বছরের ৩০ আগস্ট সাবরিনার বিরুদ্ধে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও আয়কর বিবরণী সনদ জালিয়াতির অভিযোগে মামলা হয়। মামলাটি করেন নির্বাচন কমিশনের গুলশান থানার নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাসিম। মামলাটি তদন্ত করছে ডিবির গুলশান বিভাগ।
ডিবির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সাবরিনা প্রকৃত জন্মতারিখ ও স্থায়ী ঠিকানা গোপন করে দ্বিতীয় জাতীয় পরিচয়পত্র ও আয়কর বিবরণী সনদ বানিয়েছিলেন—তদন্তে এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। ডিএসসিসির এক কর্মকর্তার যোগসাজশে সাবরিনা ভুয়া জন্মসনদ তৈরি করেন। তাঁর জন্মসনদের আবেদনে সুপারিশ করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তৎকালীন এক কর্মকর্তা।
ইসির এক কর্মকর্তার যোগসাজশে সাবরিনা এনআইডি জালিয়াতি করেন।
মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাবরিনা ২০০৯ সালে প্রথম জাতীয় পরিচয়পত্র পান। তাঁর আরেকটি জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য পেয়েছে ডিবি।
দ্বিতীয় জাতীয় পরিচয়পত্রটি ২০১৬ সালে করা। দুটি পরিচয়পত্রে সাবরিনার নামের বানান, ঠিকানা, জন্মতারিখ, পেশা ও মায়ের নামের বানানে ভিন্নতা রয়েছে।
ডিবির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, সাবরিনা ১৯৯১ সালে এসএসসি পাস করেন। ২০০০ সালে এমবিবিএস পাস করেন। তবে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে করা দ্বিতীয় জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী, তিনি ৮ বছর বয়সে এসএসসি পাস করেন। ১৭ বছর বয়সে এমবিবিএস পাস করেন। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে করা তাঁর দ্বিতীয় আয়কর বিবরণী সনদে একই ধরনের তথ্য রয়েছে।
মামলা তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সাবরিনার দ্বিতীয় জাতীয় পরিচয়পত্রটি বায়োমেট্রিক করা ছিল না। দ্বিতীয় জাতীয় পরিচয়পত্র ও আয়কর বিবরণী সনদের তথ্য প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি। এ জন্য তিনি সব জায়গায় এসব তথ্য দিচ্ছিলেন।
ডিবির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, সাবরিনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নথি থেকে তাঁর এসএসসির সনদ সরিয়ে ফেলেছেন। এ কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাবরিনার এসএসসির সনদ ডিবিকে দিতে পারেনি।
সাবরিনার আগেই গ্রেপ্তার হন তাঁর স্বামী আরিফুল হক চৌধুরী। করোনার নমুনা পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে ২০২০ সালের জুনে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
জোবেদা খাতুন হেলথ কেয়ার—সংক্ষেপে জেকেজির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আরিফুল। করোনার নমুনা পরীক্ষায় জালিয়াতি ছাড়াও আরিফুলের বিরুদ্ধে আরও তিনটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।
অপর তিনটি মামলার মধ্যে দুটি হয় ২০২০ সালের জুনে। অপরটি হয় ২০১২ সালে। প্রতারণার অভিযোগে রমনা থানায় এ মামলা হয়।
২০২০ সালের ২৫ জুন আরিফুলকে আসামি করে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করেন মোহাম্মদপুরের তোতা মিয়া নামের এক ব্যক্তি।
তোতা মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, করোনার নমুনা সংগ্রহের কাজে তাঁর প্রতিষ্ঠান নাফিস কমিউনিকেশন থেকে ১২টি ল্যাপটপ ভাড়া নেয় জেকেজি হেলথ কেয়ার। তবে ভাড়ার টাকা পরিশোধ করেনি জেকেজি। এমনকি তিনি ল্যাপটপও ফেরত পাননি।
একই মাসে মেহেদী হাসান নামের এক ব্যক্তি আরিফুলের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান সিকিউরিটি ইকুইপমেন্ট অ্যান্ড লজিস্টিক সাপোর্ট থেকে করোনার নমুনা সংগ্রহের কাজে দুটি আর্চওয়ে গেট ও ২০টি আইপি সেট ভাড়া নেয় জেকেজি। তার মধ্যে একটি আর্চওয়ে গেট জেকেজি ভেঙে ফেলেছে। তিনটি আইপি সেটও নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।
মেহেদী হাসান বলেন, ‘জেকেজি আমার ভাড়ার টাকা দিচ্ছে না। আমি নিজে আরিফুলের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। কিন্তু আমার টাকা দেওয়া হয়নি।’
করোনার নমুনা পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগে করা মামলায় ২০২০ সালের ৫ আগস্ট সাবরিনা, আরিফুলসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় ডিবি। এ মামলার বিচারকাজ চলছে। সাবরিনা-আরিফুল এখন কারাগারে।