করোনার ভুয়া প্রতিবেদন দেওয়ার মামলায় জেকেজি হেলথ কেয়ারের সাবরিনা আরিফ চৌধুরী এবং তাঁর স্বামী আরিফুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। মামলার বাদী কামাল হোসেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) বৃহস্পতিবার আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর স্ত্রীর করোনার নমুনা সংগ্রহ করে জেকেজির হুমায়ুন কবির। পরে জানতে পারেন জেকেজির সাবরিনা, হুমায়ুনসহ অন্যান্য পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণা করেছেন। তখন তিনি মামলা করেন।
মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের শুনানির তারিখ ঠিক করা হয়েছে আগামী ৩ সেপ্টেম্বর।
এর আগে গত ২০ আগস্ট করোনার নমুনা জালিয়াতির মামলায় সাবরিনা, আরিফুল হকসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। শুনানির আগে কারাগার থেকে সাবরিনা-আরিফুলসহ অন্য আসামিদের আদালতে হাজির করা হয়।
আদালতে কামাল হোসেন বলেছেন, রাজধানীর কল্যাণপুর এলাকার একটি বাসার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ওই বাসার মালিক সিরাজুল ইসলাম। বাসার মালিক সিরাজুলের করোনার উপসর্গ দেখা দিলে তাঁর ছেলে তাহমিদুল ইসলাম জেকেজি হেলথ কেয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে গত ১২ জুন জেকেজির কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির সিরাজুল ইসলামের করোনার নমুনা সংগ্রহ করেন। রাজধানীর বিজয় স্মরণীর কলমিলতা সেন্টারের সামনে এই নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
বাদী কামাল হোসেন আদালতকে আরও জানান, তাঁর মালিক সিরাজুল ইসলাম করোনার নমুনা দেওয়ার পর তিনি (কামাল), তাঁর স্ত্রী হাজেরা বেগম, গৃহকর্মী আকলিমা বেগমের করোনার নমুনা সংগ্রহ করেন জেকেজির হুমায়ুন কবির। তিন জনের নমুনা সংগ্রহ করার বিনিময়ে ১৫ হাজার টাকা দেন। পরে করোনার নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন তাঁর মালিকের ছেলে তাহমিদুলের ইমেইলে পাঠানো হয়। তিন জনের প্রতিবেদনে করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে কামাল হোসেন বলেন, টাকার বিনিময়ে করোনার নমুনা সংগ্রহ করেন জেকেজির হুমায়ুন কবির এবং তাঁর স্ত্রী তানজিনা পাটোয়ারী। সর্বশেষ গত ২২ জুন হুমায়ুন কবির তাঁর স্ত্রী হাজেরা বেগমের করোনার নমুনা সংগ্রহ করে। তখনও হুমায়ুন কবির তাঁর কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নেয়। পরে জানতে পারেন, হুমায়ুন কবির, তাঁর স্ত্রী তানজিনা পাটোয়ারী, চিকিৎসক সাবরিনা প্রতারণা করেছেন। পরে তিনি বাদী হয়ে তেজগাঁও থানায় মামলা করেন।
জবানবন্দি রেকর্ড শেষে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা জেকেজির সাবেক কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির ও তাঁর স্ত্রী তানজিনা পাটোয়ারীকে চিহিৃত করেন।
তখন হুমায়ুন কবির বলেন, বাদী কামাল হোসেন যা বলছেন, তা সবই মিথ্যা।
কামাল হোসেনের জবানবন্দি রেকর্ড করার এক পর্যায়ে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আরিফুল হক চৌধুরী রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা কেন সাক্ষীকে শিখিয়ে–পড়িয়ে দিচ্ছেন। আমি তো নিজেও ব্যারিস্টারি পড়েছি।’ তখন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, ‘যা বলার তা আপনার আইনজীবী বলবেন।
আপনি কেন কথা বলছেন? আদালতের অনুমতি ছাড়া আপনি কেন কথা বলছেন?’
তখন আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘সাক্ষীকে আপনারা কেন শিখিয়ে দিচ্ছেন।’ জবানবন্দি রেকর্ড শেষে কামাল হোসেনকে জেরা করেন জেকেজির হেলথ কেয়ারের সাবেক কর্মকর্তা হুমায়ুন কবিরের আইনজীবী মো. আবদুল জলিল খান।
আসামির আইনজীবীর করা প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী কামাল হোসেন বলেন, ২৪ বছর আগে তিনি ঢাকায় আসেন। তাঁর মাসিক বেতন ১৩ হাজার টাকা। জেকেজির হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে তিনি নিজে যোগাযোগ করেননি। তাঁর মালিকের ছেলে তাহমিদুল যোগাযোগ করেন। তিনি অনলাইন বোঝেন না। কোনো স্মার্ট ফোনও ব্যবহার করেন না।
গত ৫ আগস্ট ভুয়া করোনার রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান চিকিৎসক সাবরিনা আরিফ চৌধুরীসহ আটজনের বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিএমপি)।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, করোনা জালিয়াতিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন জেকেজির সাবরিনা ও তাঁর স্বামী জেকেজির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল হক চৌধুরী। এ দুজন ছাড়াও মামলার অন্য ছয় অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি হলেন জেকেজির সমন্বয়ক সাঈদ চৌধুরী, জেকেজির সাবেক কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির, তাঁর স্ত্রী তানজিনা পাটোয়ারী, বিপ্লব দাস, শফিকুল ইসলাম ও জেবুন্নেসা। মামলা থেকে মামুনুর রশীদ নামের আসামিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। মামলা করার ৪২ দিনের মাথায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
করোনার নমুনা সংগ্রহ ও ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে গত ২৩ জুন জেকেজি হেলথ কেয়ারের কর্মচারী হুমায়ুন কবির ও তাঁর স্ত্রী তানজিনা পাটোয়ারীকে গ্রেপ্তার করে তেজগাঁও থানার পুলিশ। পরের দিন ২৪ জুন হুমায়ুন কবির ও তানজিনা ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে হুমায়ুন কবীর জেকেজি হেলথ কেয়ারে চাকরি করার সময় কীভাবে করোনার নমুনা সংগ্রহ এবং ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করেছেন, সে ব্যাপারে বিস্তারিত তুলে ধরেন। হুমায়ুন কবির জবানবন্দিতে বলেন, করোনার নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করে ড্রেনে ফেলে দিতেন। এ ছাড়া শফিকুল ইসলামও আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন