শিশুরাই বড় শিকার

>

• ধর্ষণের শিকারদের ৮৬ শতাংশ শিশু-কিশোর
• ধর্ষণজনিত হত্যার শিকার হয়েছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শিশু-কিশোর
• সব ঘটনা জানা যায় না

গত পাঁচ বছরে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা আর ধর্ষণজনিত হত্যার মূল শিকার হয়েছে শিশু অথবা সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক তরুণীরা। এই হিসাব একটি আইন সহায়তা সংস্থার। নিজস্ব তদন্ত আর পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে সংস্থাটি এ হিসাব করেছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এ হিসাবে প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রেই ঘটনার শিকার নারীর বয়স দেওয়া নেই। কিন্তু বাকিদের ৮৬ শতাংশ শিশু-কিশোরী। ধর্ষণজনিত হত্যার শিকার নারীরও প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এই বয়সী। এদের বড় অংশটিরই বয়স ১২ বছরের মধ্যে। এই বয়সীদের মধ্যে গণধর্ষণের শিকারও আছে।

এ হিসাব অনুযায়ী, পাঁচ বছরে ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার শিকার নারীর সংখ্যা মোট চার হাজারের মতো। আরও কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন পত্রিকার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই হিসাব রাখে, তবে সেগুলো আরও অসম্পূর্ণ। দেশে ধর্ষণের ঘটনা আসলেই কত, এর প্রবণতা ঠিক কী, মামলা হলে বিচারের পরিস্থিতি কী—এসব বিষয়ে জাতীয় কোনো তথ্যভান্ডার নেই।

ধর্ষণ বিষয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের মতে ঘটনা অনেক বেশি। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে পাঁচ বছরে ১৯ হাজারের বেশি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। অর্থাৎ দিনে গড়ে ১১টি মামলা হচ্ছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ধর্ষণের সব ঘটনায় মামলা হচ্ছে না। পরিবার প্রথমেই ঘটনা গোপন করতে চায়। শিশুদের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ ঘটনা ঘটছে ঘরের ভেতরে, আপনজনদের মাধ্যমে। শিশু বিকারগ্রস্ত হলে, গুরুতর আহত হলে বা সবাই জেনে গেলে তখনই পরিবার মামলা করছে।

ফরিদা ইয়াসমিন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের দায়িত্বে আছেন। তিনি জানালেন, চলতি বছরের প্রথম দুই সপ্তাহে আটটি চাঞ্চল্যকর ধর্ষণ মামলা তাঁদের কাছে তদন্তের জন্য এসেছে। শিশু ধর্ষণকে বিশেষ গুরুত্ব দেন তাঁরা।

চলতি বছরের প্রথম ১৮ দিনে প্রথম আলোয় ২৩টি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জনই শিশু-কিশোরী। এর মধ্যে দুই বছরের শিশুও আছে। চারজনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। আরেকজন ধর্ষণের পর অসুস্থ হয়ে মারা গেছে।

সাতক্ষীরায় দ্বিতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ উঠেছে গৃহশিক্ষকের ভাইয়ের বিরুদ্ধে। নীলফামারীর সৈয়দপুরে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে বিদ্যালয়টির এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। পুরান ঢাকার এক বস্তির দুই বছরের একটি মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে প্রতিবেশী এক বাড়িওয়ালার ভাইয়ের বিরুদ্ধে। ডেমরায় প্রতিবেশী এক যুবকের ফ্ল্যাটে চার ও পাঁচ বছর বয়সী দুই শিশুকে মৃত পাওয়া গেছে। পুলিশ বলছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি তাদের লিপস্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ঘরে ডেকে নিয়ে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে হত্যা করেছেন।

আসকের হিসাব বলছে, গত পাঁচ বছরে ধর্ষণজনিত হত্যার শিকার হয়েছে ২৭৮ জন। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে ৪২ জন। বেশির ভাগেরই বয়সের তথ্য আছে। তা থেকে দেখা যায়, আত্মহত্যাকারীদের ৮৬ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের মধ্যে।

বছরওয়ারি ধর্ষণের সংখ্যা অল্পবিস্তর বাড়ে-কমে। আসকের হিসাবে, ২০১৪ সালে ৬২৬ জন থেকে সবচেয়ে বেশি হয়েছিল ২০১৭ সালে; ৮১৮ জন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হিসাবও কাছাকাছি। আসক ৮টি জাতীয় পত্রিকা দেখেছে, মহিলা পরিষদ ১৫টি।

পুলিশের হিসাবেও গত পাঁচ বছরে মামলার সংখ্যার বড় কোনো ওঠানামা চোখে পড়ে না। পুলিশ সদর দপ্তর সারা দেশের ধর্ষণ মামলার বিস্তারিত পরিসংখ্যান রাখে। দপ্তরের সূত্র বলছে, এ তথ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়। প্রথম আলোকে পুলিশ শুধু মামলার সংখ্যা দিয়েছে।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য ‘মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচি’ নামে পরিচিত একটি কার্যক্রম আছে। এই কর্মসূচির অধীনে ‘ন্যাশনাল ডেটাবেইস অন ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন’ নামে একটি তথ্যভান্ডার গড়ে তোলার কথা আছে। কিন্তু বহু বছরেও এ কাজ শুরু হয়নি।

মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের দায়িত্বে থাকা (উপসচিব) গাজী উদ্দিন মো. মনির প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা জেলা ও উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাদের পাঠানো তথ্য আর গণমাধ্যমে প্রকাশিত চাঞ্চল্যকর নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনার ওপর নজর রাখেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা নিতে চিঠি পাঠান।

মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচির অধীনে দেশের ৯টি বড় হাসপাতালে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের জন্য ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) আছে। এখানে একই ছাতার নিচে চিকিৎসা, আইনি সেবা ও সীমিত পুনর্বাসনের সেবা দেওয়া হয়। সেবাগ্রহীতাদের এবং মামলার হিসাব ওসিসি রাখে। তবে আলাদা করে না রেখে ধর্ষণের ঘটনাকে আরও নানা ধরনের যৌন নির্যাতনের সঙ্গে একত্রে হিসাব করা হচ্ছে।

নয়টি ওসিসিতে সূচনাকাল ২০০৬ সাল থেকে গত বছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত যৌন নির্যাতনের অভিযোগে প্রায় ছয় হাজার মামলা হয়েছে। দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রেই নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা শিশু। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসির সমন্বয়কারী বিলকিস বেগম প্রথম আলোকে বলেন, সেবাগ্রহীতাদের বড় অংশ মামলা করতে চান না।

এ পর্যন্ত এক-চতুর্থাংশ মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ৭ শতাংশ মামলায় আসামির সাজা হয়েছে। ওসিসির মামলাগুলো নিবিড় তদারকিতে থাকে। প্রথম আলো ঢাকা জেলার পাঁচটি নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে প্রায় ১৫ বছরে (২০০২-১৬) আসা ধর্ষণ-সংক্রান্ত পাঁচ হাজারের মতো মামলার পরিস্থিতি অনুসন্ধান করেছিল। দেখা যায়, নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মাত্র ৩ শতাংশের সাজা হয়েছে। চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে প্রশাসন কয়েক দিন দৌড়ঝাঁপ করে। তারপর সব থিতিয়ে যায়। মামলার বিচারেও নজরদারির অভাব দেখা যায়।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রের ব্যক্তিরা বলছেন, ধর্ষণের পূর্ণাঙ্গ তথ্য গোছানো না থাকায় এর মোকাবিলার কৌশল পরিকল্পনা করা কঠিন। জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসী সুলতানা সরকারের নারীবিষয়ক বিভিন্ন নীতি-পরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত আছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ বা মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে পূর্ণাঙ্গ একটি তথ্যভান্ডার থাকা প্রয়োজন। এটা সরকারের পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য জরুরি।

ফেরদৌসী বলেন, এটা ঠিক যে বাংলাদেশে যথাযথ তথ্য নেই। কিন্তু যেটুকু আছে সেগুলোর আলোকেও নীতি বা কাজ হচ্ছে না।

শিশুদের যৌন নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষায় কাজ করছে বেসরকারি সংগঠন ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স। এর নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা বলেন, দেখা যাচ্ছে পরিচিত বা আপনজনেরাই শিশুদের চকলেট, লিপস্টিক, খিচুড়ির লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ করছে। তাই সন্তান একটু বড় হলেই তাকে বলতে হবে যে এভাবে গোপনে কেউ কিছু দিতে চাইলে তার সঙ্গে না যেতে। ছেলেশিশুদের যৌন নির্যাতনের ঘটনাতেও মুখ খুলতে হবে। তিনি বলেন, তাই শিশুর যৌন নির্যাতনের ঝুঁকি সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরির কাজে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। 

সুলতানা কামাল


অভিমত
আইনের প্রয়োগ জরুরি
সুলতানা কামাল, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
ধর্ষণসহ শিশুরা যেকোনো সহিংসতার শিকার হওয়ার পর সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলেন, শিশুদের সুরক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু তারপর তা আর দেখা যায় না। একটার পর একটা ঘটনা ঘটতেই থাকে। এ ছাড়া শিশুদের সুরক্ষায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়টা পরিবারের ঘাড়েই চাপানো হয়। পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, তা সত্য। তবে রাষ্ট্রকেও শিশুদের রক্ষায় বিশেষ নজর বাড়াতে হবে।

শিশুরা যে হারে সহিংসতার শিকার হচ্ছে তাতে করে শিশুদের সহিংসতার হাত থেকে বিশেষভাবে সুরক্ষা দিতে সুনির্দিষ্ট আইন থাকলে ভালো হয়। তবে বর্তমানের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনসহ সংশ্লিষ্ট যেসব আইন আছে, তাতেও অপরাধীদের জন্য বিভিন্ন সাজার কথা বলা আছে। এসব আইনের প্রয়োগ জরুরি। ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার মতো ঘটনায় রাষ্ট্রকে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাতে হবে। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ এবং ঘটনার পর বিচারপ্রাপ্তিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।

আরও পড়ুন: