সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ‘রক্তাক্ত’ কিশোর শাহীন আলম এখন অনেকটাই সুস্থ। কিন্তু যশোরের এই কিশোর কিছুতেই সেদিনের কথা ভুলতে পারছে না। একটু পরপর বলছে, ‘কইলাম ভ্যানডা নিয়েন না, জানে মাইরেন না। কিন্তু আমার কথা শুনল না। ভ্যানডা নিল, নিক, আপত্তি নাই, কিন্তু মারল কেন?’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শাহীন আলম কথাগুলো বলেই কান্না শুরু করে। উত্তেজিত হয়ে পড়ে। যেন সে তার চোখের সামনে দুর্বৃত্তদের দেখতে পাচ্ছে, তাকে না মারতে কাকুতি-মিনতি করছে।
শাহীন উত্তেজিত হয়ে গেলে পাশে বসা মা খাদিজা বেগম ছেলেকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে যান। কিন্তু শাহীনের সঙ্গে পেরে ওঠেন না। তাই হাসপাতালের বিছানার সঙ্গে গামছা দিয়ে শাহীনের এক হাত ও এক পা বেঁধে রেখেছেন। বললেন, ‘এ ছাড়া আর কোনো উপায় নাই।’
গত সোমবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, শাহীনের অপলক দৃষ্টিতে এখন শুধুই ভয়। সারাক্ষণ অস্থির হয়ে আছে। বারবার তার হাত চলে যায় মাথার ক্ষতস্থানে। মা জানালেন, ছেলের চোখে ঘুম নেই। চিৎকার করে। এতে ওয়ার্ডের অন্য রোগী ও স্বজনেরা বিরক্ত হন। তবে একটু পরই শাহীনের কষ্টটা বুঝতে পারেন। কাছে এসে কথা বলেন। কিন্তু মা হয়ে ছেলের এই কষ্ট আর তিনি সহ্য করতে পারছেন না। বললেন, ‘ওর কষ্টের যে সিন, তা দেখা যায় না, সহ্য করা যায় না। মাথার ভেতর মনে হয় যন্ত্রণা করে। মুখ খারাপ করে। অস্থির হয়ে যায়।’
গত ২৮ জুন সাতক্ষীরায় যাত্রীবেশী দুর্বৃত্তরা শাহীনের ভ্যান ছিনতাইয়ের পর তার মাথায় আঘাত করে। আঘাত ও রক্তক্ষরণের ফলে অচেতন হয়ে পড়েছিল শাহীন। জ্ঞান ফিরলে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে।
শাহীনের বাড়ি যশোরের কেশবপুরে। গোলাঘাটা দাখিল মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সে। পড়াশোনার পাশাপাশি বাবা হায়দার মোড়লের সঙ্গে সে ভ্যান চালাত। তার ছোট দুই বোন আছে। জায়গা-জমি নেই।
শাহীন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে প্রায় এক মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর এখন ওয়ার্ডে আছে। কেবিন পেয়েছে, তবে চিকিৎসকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে থাকার জন্য খাদিজা বেগম ছেলেকে নিয়ে ১০ দিন ধরে ওয়ার্ডে আছেন। চিকিৎসার ব্যয় বহন করছে সরকার।
শাহীনের মা ও স্বজনেরা প্রথমে শুনেছিলেন শাহীন মারা গেছে। সেই জায়গা থেকে ছেলে বর্তমানে চোখের সামনে কথা বলছে, খাচ্ছে—এতেই সন্তুষ্ট সবাই।
মা খাদিজা ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভ্যান নিছে সমস্যা নাই। তোমারে না মারলে খুশি হইতাম। আমরা না হয় না খাইয়্যা থাকতাম।’ আবার বললেন, ‘তুমি সুস্থ হয়ে যাবানে। পাগল হইয়াও তুমি তো আমার কোলে ফিরি যাবানে।’
দুর্বৃত্তদের হামলার পর স্থানীয় লোকজন শাহীনকে প্রথমে সাতক্ষীরা হাসপাতালে নেন। পরে তাকে খুলনার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে নেওয়া হয়। তারপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। দুর্বৃত্তদের আঘাতের কারণে শাহীনের খুলির ভাঙা হাড়ের ছোট ছোট অংশ মস্তিষ্কে আঘাত করেছিল। এগুলো অপসারণ করা হলেও ভাঙা হাড়ের জায়গা ফাঁকাই থেকে গেছে।
সোমবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক (রেসিডেন্ট) চিকিৎসক মোহাম্মদ সাকিব ইমতিসার প্রথম আলোকে বললেন, শাহীনের মাথার আঘাত গুরুতর ছিল। অস্ত্রোপচারের পর কিছুটা সংক্রমণ আছে এখনো। ওর কিছুটা মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে শাহীনের শারীরিক পরিস্থিতি বর্তমানে বেশ ভালো একটা অবস্থানে এসেছে। তার মাথায় কৃত্রিম হাড় লাগানোর চিন্তাভাবনা চলছে। হাসপাতালে আর কত দিন থাকতে হবে, তা এখনো সেভাবে বলা যাচ্ছে না।
ঘটনার পর শাহীনের বাবা হায়দার আলী মোড়ল বাদী হয়ে পাটকেলঘাটা থানায় মামলা করেন। ১ জুলাই ভ্যান ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশ যশোরের কেশবপুর উপজেলার বাজিতপুর গ্রামের নাইমুল ইসলাম (২৪), সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার আলাইপুর গ্রামের আরশাদ পাড় ওরফে নুনু মিস্ত্রি (৬৫) ও সাতক্ষীরা সদর উপজেলার গোবিন্দকাটি গ্রামের বাকের আলীকে (৪৫) গ্রেপ্তার করে। উদ্ধার করা হয় শাহীনের ভ্যানটিও। তবে শাহীনের মা খাদিজা জানালেন, উদ্ধার করা ভ্যানের ব্যাটারিসহ বিভিন্ন অংশ বিক্রি করে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। তাই এই ভ্যান দিয়ে আর কোনো কাজ হবে না।
খাদিজা জানালেন, দুর্বৃত্তরা তাঁদের পরিচিত। পরিচিত হয়েও শাহীনকে এভাবে মারতে পেরেছে, তা খাদিজা বিশ্বাসই করতে পারছেন না।
ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর উপপ্রেসসচিব আশরাফুল আলম খোকন এক ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছিলেন, যশোর থেকে ঢাকা মেডিকেলে আসা এবং অপারেশন থেকে শুরু করে চিকিৎসার সব কাজে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-কর্মীরা সহায়তা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী তাঁর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া সার্বিক যোগাযোগ করেছেন।
শাহীনের মা খাদিজা জানালেন, ঘটনার পর থেকে সরকারের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গা থেকে সহায়তা পেয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসা বিনা মূল্যেই হচ্ছে। তবে জরুরি ভিত্তিতে কিছু ওষুধ নিজেদের কিনতে হচ্ছে। হাসপাতালে খাদিজার সঙ্গে তাঁর এক বোনের স্বামী থাকছেন। ঢাকা মেডিকেলে বলতে গেলে তাঁদের আরেকটা সংসার চালাতে হচ্ছে। ছোট মেয়েদের দেখার জন্য শাহীনের বাবাকে থাকতে হচ্ছে গ্রামের বাড়িতে। সেখানেও খরচ আছে। আর বিভিন্ন জন যে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন, তাও প্রায় শেষ হয়ে আসছে। আর শাহীনের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তা তো আছেই।
হাসপাতাল থাকা অবস্থায় প্রতিবেদকের সঙ্গে শাহীন টুকটাক কথা বলে। প্রতিবেদক একটু হাসতে বলে এক ফাঁকে একটু হাসিও দেয়। মুঠোফোনে তোলা শাহীনের ছবি দেখানো হলে খুশি হয়।