স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের স্নাতকের ছাত্রী রুবাইয়াত শারমিনের মৃত্যুর কারণ কী, সে উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। ঘটনাটির তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, শারমিন খুন হয়েছেন, সেটি ধরেই তদন্ত হচ্ছে। তাঁর মুঠোফোনের কললিস্ট যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কিন্তু কে বা কারা, কীভাবে এবং কোন কারণে তাঁকে হত্যা করেছে বা করে থাকতে পারে, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি।
রুবাইয়াত শারমিনের (রুম্পা) মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে সিদ্ধেশ্বরীতে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের সামনে গতকাল সকালে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন তাঁর সহপাঠীরা। হত্যার বিচার চেয়ে স্লোগান দেন তাঁরা। আজ শনিবার সকাল ১০টায় তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধেশ্বরী ও ধানমন্ডি ক্যাম্পাসের সামনে অবস্থান নেবেন।
সহপাঠী শাহরিয়া তাসনিম বলেন, এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত এবং শারমিনকে হত্যা করা হয়ে থাকলে জড়িত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এর আগে গত বুধবার রাতে সিদ্ধেশ্বরী এলাকার রাস্তা থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন রাতে স্বজনেরা রমনা থানায় লাশের ছবি দেখে শারমিনের পরিচয় শনাক্ত করেন। এক ভাই, এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। তাঁর বাবা রোকনউদ্দিন হবিগঞ্জের একটি পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক।
ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার এস এম শামীম প্রথম আলোকে বলেন, শান্তিবাগে ভাড়া বাসায় মায়ের সঙ্গে থাকতেন শারমিন। এই বাসায় তাঁর চাচার পরিবারের সদস্যরাও থাকতেন। তিনি মারা গেলেন প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে সিদ্ধেশ্বরীতে। সেখানে তাঁর কোনো আত্মীয়স্বজনের বাসাও নেই। বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হওয়াতেই তাঁরা হত্যা মামলা নিয়েছেন।
পুলিশের এই সহকারী কমিশনার বলেন, শারমিনের লাশ পাওয়া গেছে তিনটি ভবনের মাঝখানে। বুধবার রাত সোয়া ১০টার দিকে ওপর থেকে কিছু একটা পড়ার শব্দ শুনে আশপাশের ভবনের লোকজন প্রথমে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ ফোন করেন। পরে সেখান থেকে থানায় বিষয়টি জানানো হয়। তিনি বলেন, লাশটি তিনটি ভবনের মাঝখানে পড়ে ছিল।
যে এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানে পাশাপাশি তিনটি ভবনের একটি ১২ তলা (আয়েশা শপিং কমপ্লেক্স)। এর চারতলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক (দোকান, বিভিন্ন অফিস) কার্যক্রম চলে। পঞ্চম তলা থেকে আবাসিক ফ্ল্যাট। আর বাকি দুটি আবাসিক ভবনের একটি তিনতলা, অন্যটি পাঁচতলা। এর মধ্যে পাঁচতলা ভবনের ছাদে টিনের কাঠোমো। তিনটি ভবনের কোনোটিতেই সিসি ক্যামেরা নেই। তাই কোন ভবনটিতে শারমিন ঢুকেছিলেন, তা জানা যায়নি।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, যে স্থানে শারমিনের লাশ পড়েছিল, তা একটি গলির শেষ মাথা। এর ডান দিকে তিনতলা আর বাঁ দিকে পাঁচতলা ভবন। ১২ তলা ভবনের পেছনের দিকে লাশ পড়েছিল।
পুলিশ সূত্র জানায়, দুটি টিউশনি করে বুধবার সন্ধ্যায় শারমিন বাসার নিচে আসেন। ওপরে না উঠে তিনি মুঠোফোনে চাচাতো ভাইকে নিচে নামতে বলেন। তার কাছে আংটি, কানের দুল, মুঠোফোন, ব্যাগ দিয়ে দেন। এর পর পুরোনো এক জোড়া জুতা আনতে বলেন। চাচাতো ভাই জুতা নিয়ে আসার পরে সেই জুতা পরে তিনি চলে যান। রাতে আর বাসায় ফিরে আসেননি। স্বজনেরা বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও তাঁর সন্ধান পাননি।
পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, শারমিনের মেরুদণ্ড, বাঁ হাতের কনুই ও ডান পায়ের গোড়ালি ভাঙা ছিল। মাথা, নাক, মুখে জখম এবং বুকের ডান দিকে ক্ষতচিহ্ন ছিল।
রমনা থানার পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা বিভাগও (ডিবি) এ ঘটনার ছায়া তদন্ত করছে। ডিবির রমনা অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার শামসুল আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, তিনটি ভবনের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু আয়েশা কমপ্লেক্সের ১২ তলার ছাদে একটি জুতার ছাপ পাওয়া গেছে। ওই ছাদে কোনো রেলিং নেই। ছাদের এক পাশ একটু ঢালু। সেখানে জুতার ছাপটি পাওয়া গেছে। লাশের সঙ্গে পড়ে থাকা জুতার সঙ্গে ওই ছাপের মিল আছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে কাজ করছে। এ ছাড়া তাঁর মুঠোফোনটিতে পাসওয়ার্ড থাকায় সেখান থেকেও কোনো তথ্য বের করা সম্ভব হয়নি। মুঠোফোনটিও তাই ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সিআইডিতে পাঠাতে তাঁরা থানা–পুলিশকে পরামর্শ দিয়েছেন।
এদিকে গতকাল ভোরে শারমিনের লাশ ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বিজয়নগরে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
শারমিনের বাবা পুলিশ পরিদর্শক রোকন উদ্দিন বলেন, শারমিনের মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশের উচিত তাঁর সহপাঠী এবং যাঁদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাঁদের সঙ্গে কথা বলা। মুঠোফোন কললিস্ট ধরে পুলিশ তদন্ত করতে পারে। তিনি মেয়ে হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও দ্রুত বিচার চেয়েছেন।