লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি মানব পাচার বেড়ে যাওয়ায় ২০১৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে গৃহযুদ্ধকবলিত আফ্রিকার দেশটিতে বাংলাদেশের লোকজনের যাওয়া বন্ধ করে দেন আদালত। পরের কয়েক বছর লিবিয়া হয়ে মানব পাচার বন্ধের জন্য কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়। কিন্তু মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে পাচারকারীরা। দেশে মানব পাচারের উৎস বন্ধ করতে হলে জোরালো রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি।
কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা বলছেন, লিবিয়া হয়ে মানব পাচারে দেশি-বিদেশি শক্তিশালী গোষ্ঠী জড়িত। এদের খুঁটি এতটাই শক্তিশালী যে অতীতে ত্রিপোলিতে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের হুমকি দিয়েছে। দূতাবাসের স্থানীয় কর্মীদের আটকে রাখার মতো সাহস দেখিয়েছে। তাই মানব পাচারের এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে বিভিন্ন দেশ এবং জাতিসংঘের মতো সংস্থাকে নিয়ে বাংলাদেশকে কাজ করতে হবে।
লিবিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশের বর্তমান ও সাবেক চারজন কূটনীতিক গত শনিবার ও গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, মানব পাচারের শিকার হওয়া যেসব অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষ ধরা পড়েছেন, তাঁরা সবাই জানেন কোন দালালকে কত টাকা দিয়েছেন। কার মাধ্যমে দিয়েছেন। বাংলাদেশের কোন ব্যাংক হিসাবে তা জমা হয়েছে। এই হিসাবও কিন্তু অতীতের সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার মিজদায় ২৬ বাংলাদেশি নিহত ও ১১ জন আহত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে কূটনীতিকেরা জানান, অতীতেও মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুরসহ বৃহত্তর ফরিদপুর এবং সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ এ অঞ্চলের দালালেরা সক্রিয় ছিল। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এবারও দেখা যাচ্ছে, ওই দালাল চক্রই জড়িত গত বৃহস্পতিবারের নির্মম হত্যার শিকার হওয়া লোকজনের পাচারে।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ ফেলো মো. শহীদুল হক বলেন, ‘ভূমধ্যসাগরে মানব পাচারের ঢল নামার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে লিবিয়ায় লোক পাঠানো বন্ধ হয়েছিল। এরপর পাচারকারীরা ঢাকার পরিবর্তে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে লোকজনকে ভারত ও নেপালের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের মাধ্যমে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। তা থামানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। ওই সময় ইউরোপে আমাদের অনেক লোক অবৈধভাবে পাড়ি জমাতে গিয়ে আটকা পড়েন। আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে তাঁদের ফেরাতে একটি চুক্তিও করেছি। বিদেশের দূতাবাসগুলোর তথ্য ও পরামর্শের ভিত্তিতে দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়ে ওই সময়টাতে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। ফলে মানব পাচারের ক্ষেত্রে অন্তত ২০১৭ পর্যন্ত পরিস্থিতি অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। গত সপ্তাহে লিবিয়ার বিয়োগান্তক ঘটনার পর মনে হচ্ছে, এই ধরনের অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের সমন্বিত এই প্রয়াসে ছাড় দেওয়া বা কিছুটা আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো সুযোগ নেই।’
মানব পাচারের সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস নিয়মিত কোনো মতামত বা সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠাত কি না, এর আলোকে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদুল হক বলেন, এর আগে দেশে মানব পাচারের বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে, তা দূতাবাসের পাঠানো তথ্য ও সুপারিশকে বিবেচনায় নিয়েই হয়েছে। তাঁর মতে, মানব পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ব্যক্তিরা সংকটকালে বেশি সক্রিয় থাকে। এবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তাদের জন্য নতুন সুযোগ করে দিয়েছে। মহামারির কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতি পর্যুদস্ত। নিয়মিত অভিবাসনের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ছে। এটাকে পুঁজি করে তারা ভূমধ্যসাগরে মানব পাচারে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
অতীতে মানব পাচার বন্ধে দূতাবাস ও মন্ত্রণালয় কী ব্যবস্থা নিয়েছে, এ ব্যাপারে লিবিয়ায় বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শাহিদুল হক রোববার প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ত্রিপোলিতে বাংলাদেশ দূতাবাস, র্যাব ও পুলিশের ইকনোমিক ইন্টিলিজেন্স ইউনিট নামে একটি শাখা সমন্বিতভাবে মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত পরিচালিত সমন্বিত ওই উদ্যোগ খুব কার্যকর ছিল।
শাহিদুল হক জানান, পুলিশের ইকোনমিক ইন্টিলিজেন্স ইউনিট বৃহত্তর ফরিদপুরের মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি পদক্ষেপ নিয়ে তাদের গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। দূতাবাসের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা সংস্থা বেশ ত্বরিতগতিতে অনেক সফল অভিযান চালিয়েছিল।
ঢাকা ও লিবিয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুওয়ারা, জিনতানসহ লিবিয়ার বিভিন্ন এলাকা এখনো মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণে। তাই মানব পাচারের বিষয়টি তাদের নিয়ন্ত্রণে। যেসব লোক ইউরোপ যাওয়ার জন্য লিবিয়ায় আসছেন, তাঁরা বেনগাজি দিয়ে আফ্রিকার দেশটিতে প্রবেশ করেন। তাঁদের লিবিয়ার ভিসা থাকে না। থাকে অন্য দেশের ভিসা। ফলে অবৈধ ওই প্রক্রিয়ার অনেক কিছুই ঠিক করে মিলিশিয়া আর মানব পাচারকারীরা।
ত্রিপোলি থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ সেকান্দার আলী গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘লিবিয়ার বিভিন্ন অংশে তো বটেই, মানব পাচারকারীর দালালেরা যে দেশগুলো হয়ে লোকজনকে আনে, সেখানে বেশ সক্রিয় থাকে। তাই এদের প্রতিহতের চেষ্টাটা সবাইকে মিলে করতে হবে। জাতিসংঘের স্থানীয় দপ্তরকে এ সমস্যা সমাধানে সংবেদনশীল করার চেষ্টা করছি। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গেও কথা বলছি। মানবপাচারের শিকার হওয়া লোকজনের কাছ থেকে পাচারকারী ও দালালদের পরিচয় জানার পর দূতাবাস জড়িত ব্যক্তিদের নামের তালিকা প্রকাশ করে। এ জন্য আমাদের ওপর অনেক চাপ ও হুমকি আসে। লিবিয়ার স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে পাচারকারীদের আন্তর্জাতিক চক্র আমাদের হুমকি দেয় টেলিফোনে। অনেক সময় দূতাবাসের লোকজনের ওপর পাচারকারীরা হামলা চালায়। পাচারকারীরা অতীতে দূতাবাসের স্থানীয় কর্মীদের নিয়ে আটকে রাখার মত ঔদ্ধত্যও দেখিয়েছে।’
গত বৃহস্পতিবার মিজদায় অপহরণকারীদের গুলিতে আহত ১১ জনের মধ্যে পাঁচ থেকে ছয়জন শঙ্কামুক্ত। যদিও সবার গায়ে গুলি লেগেছে। অন্যরা বেশ অসুস্থ। তাই তাঁদের সুস্থতার ওপর আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। তাঁদের সুস্থ করে দেশে পাঠানো হবে। তা ছাড়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে আকাশপথে এ মুহূর্তে যোগাযোগ বন্ধ। আইওএমের মাধ্যমে ওদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামর্থ্য যে আছে, সেটা কিন্তু জঙ্গিবাদ দমনে প্রমাণ হয়েছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল বলেই কিন্তু আমাদের পক্ষে জঙ্গিবাদ দমন করা সহজ হয়েছে। কিন্তু মানব পাচারের ক্ষেত্রে কিন্তু একই ধরনের রাজনৈতিক সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ দেখি না। বিমানবন্দর দিয়ে লোকজন যখন যায়, তাঁদের ঠিকমতো যাচাই করলেই কিন্তু বের করা সম্ভব তাঁরা বেড়াতে যাচ্ছেন না। মিসরসহ যে দেশগুলো হয়ে মানব পাচারকারীরা লোকজনকে নিচ্ছেন, সেখানে তো তাঁদের বেড়াতে যাওয়ার কথা নয়। তাঁদের কারা পাঠাচ্ছে, এটা বের করা খুব কঠিন নয়। একটা বড় এবং শক্তিশালী চক্র এই কাজটি এ দেশে করে যাচ্ছে। আমাদের দেশে মানব পাচারবিরোধী আইন আর কর্মপরিকল্পনা যে হয়েছে, সেগুলো কি নিজেদের উদ্যোগে করেছি? এগুলো তো মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর আর উন্নয়ন সহযোগীদের চাপে করেছি। কাজেই আমাদের দেশে মানব পাচারের উৎসে গিয়ে সমস্যার সমাধান করতে হলে জোরালো রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। এটি ছাড়া মানব পাচার রোধ করা রীতিমতো অসম্ভব।’