কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে গত চার বছরে অন্তত ১০৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির (বিপিও) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য এসেছে।
কেবল খুনোখুনি নয়, অপহরণ, ধর্ষণ, ডাকাতি, মাদক চোরাচালানসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে দিন দিন বাড়ছে বলে নানা পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। সর্বশেষ আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যার পর রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতার বিষয়টি আবার সামনে এসেছে।
বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির (বিপিও) ‘রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তা: সহিংসতার মাত্রা’ শীর্ষক প্রতিবেদনের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত গত চার বছরের টেকনাফ ও উখিয়ার শিবিরগুলোতে ১০৮ জন নিহত হয়েছেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন হালনাগাদ করে আসছে। প্রতিবেদনটি গত আগস্ট পর্যন্ত হওয়ায় গত বুধবার আততায়ীদের গুলিতে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর নিহত হওয়ার তথ্য এতে যুক্ত হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ ‘পার্টনারশিপস ফর আ টলারেন্ট অ্যান্ড ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ’ নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সেই প্রকল্পের একটি অংশ বিপিও।
বিপিওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিহত ১০৮ জনের মধ্যে ৭৮ জনকে অতর্কিতভাবে দুর্বৃত্তরা খুন করে গেছে। বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে প্রাণ হারান ২২ জন। অপহরণের পর হত্যা করা হয় দুজনকে। এ ছাড়া বিভিন্ন ঘটনায় খুন হন ৬ জন।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পারিবারিক কারণে রোহিঙ্গাদের বেশ কয়েকটা খুনের ঘটনা আমরা দেখেছি। আবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণেও খুন হয়ে থাকে। এ ছাড়া খুনোখুনির পেছনে আরও অনেকগুলো কারণ আছে।’
বিপিওর প্রতিবেদন, পুলিশ ও শিবির–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা এ দেশে আসা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে আশ্রয়শিবিরগুলোতে নানা রকম অপরাধ কর্মকাণ্ড শুরু হয়। শুরুর দিকে বেশ কটি খুনের ঘটনা ছিল রাখাইনে পূর্বশত্রুতার জের ধরে। এরপর শিবিরগুলোতে আধিপত্য বিস্তার এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দ্বন্দ্ব–সংঘাত হয়। ডাকাতি, অপহরণ, মাদক ও মানব পাচারের মতো ঘটনার জেরেও কিছু খুন হয়েছে। পারিবারিক কারণেও কিছু ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে প্রত্যাবাসনের পক্ষে–বিপক্ষের বিরোধ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক হিসাব থেকে জানা গেছে, প্রথম তিন বছরে প্রায় ১২ ধরনের অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ৭৩১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অনেকে জেলও খেটেছেন।
রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয় রোহিঙ্গা শিবিরে কাজের অভিজ্ঞতা থাকা মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খানের কাছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে শুরুতে একধরনের অবস্থা বিরাজ করছিল। যত সময় যাচ্ছে, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেশ কিছু সমস্যা বাড়ছে।
নূর খান বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আছে। মাদক কারবারিদের যেমন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আছে, আবার আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন (আরএসও) ও ইসলামি মাহাতের মতো রাজনৈতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের অস্তিত্বের কথাও শোনা গেছে। তাদের ভেতর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত আছে। এতে হত্যাকাণ্ড যেমন হচ্ছে, চাঁদাবাজিও হচ্ছে। এর বাইরে পারিবারিক সহিংসতাও রয়েছে।
তবে রোহিঙ্গা শিবিরে এত দিন যেসব কারণে হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সর্বশেষ মুহিবুল্লাহকে হত্যার ঘটনা সে রকম নয়। বিশ্লেষকদের মতে, মুহিবুল্লাহ ছিলেন সাধারণ রোহিঙ্গাদের কণ্ঠস্বর। তাঁর মতো যাঁরা অহিংস পন্থায় বা শান্তিপূর্ণভাবে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চিন্তা করেন এবং তাঁরা যখন পুরো শিবিরে জনপ্রিয়তা পান, মানুষকে সংগঠিত করেন; তখন আরসার মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা উগ্র রাজনীতিতে বিশ্বাসীরা একধরনের হুমকি অনুভব করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও বিপিওর পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যত দেরি করবে, খুনসহ নানা রকম সমস্যা তত বাড়বে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে মিয়ানমার সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করে এ সমস্যার সমাধান করা।
(প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন টেকনাফ প্রতিনিধি )