বাজারে সেরা মানের একেকটি ব্রেক সুর দাম সাড়ে ১৩ হাজার টাকা। অথচ একই জিনিস রেলের একটি পাজেরো গাড়ির জন্য কেনা হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা দরে। এয়ার ক্লিনার ফিল্টারের দাম বড়জোর ২ হাজার টাকা। কিন্তু কেনা হয় প্রায় ১৩ হাজার টাকায়। ভালো মানের মবিল ফিল্টারের বাজারদর যেখানে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪০০ টাকা, রেলের ওই গাড়িতে লাগানো এই জিনিসের দাম দেখানো হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার টাকা।
এভাবে বাজারদরের কয়েক গুণ দামে ক্লাচপ্লেট, ডিজেল ফিল্টার, রিকন্ডিশন্ড ইঞ্জিন, পপুলার শ্যাফটের কলকি ও গিয়ার বক্সের মাউন্ট কেনা হয়েছে রেলের পশ্চিমাঞ্চলে। সব মিলিয়ে একটি মিতসুবিশি পাজেরো গাড়ি মেরামতের পেছনেই ব্যয় হয়েছে সাড়ে ৮ লাখ টাকার বেশি। মেরামতের যে বিল পাস করা হয়েছে, তা থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
মেরামত করা গাড়িটির নিবন্ধন নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৬১৯৩। এটি ব্যবহার করছেন লালমনিরহাট অঞ্চলের রেলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম)। এই মেরামতপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে রেলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের (পশ্চিম) দপ্তর। এর তৎকালীন প্রধান ছিলেন বেলাল হোসেন সরকার। বর্তমানে তিনি সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের (পূর্ব) দায়িত্ব পালন করছেন।
রেলের কেনাকাটায় যুক্ত একটি সূত্র বলছে, রেলে কেনাকাটায় অনিয়ম প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনা। বেশির ভাগ ঘটনাই সামনে আসে না। এই একটি ঘটনা সার্বিক অবস্থারই যেন প্রতিচ্ছবি।
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, দুর্নীতি-অনিয়মের ব্যাপারে তাঁর অবস্থান জিরো টলারেন্স। যেখানেই অভিযোগ পাচ্ছেন, সেটার তদন্ত করা হচ্ছে। ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। গাড়ি মেরামতে অনিয়ম হয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
করোনাকালের শুরুতে রেলওয়ে গ্লাভস, মাস্ক, থার্মোমিটার, জীবাণুনাশক টানেল, সাবানসহ প্রায় ৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকার বিভিন্ন সুরক্ষাসামগ্রী কেনে। সব পণ্যই বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দামে কেনার অভিযোগ ওঠে। পরে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের করা তদন্ত কমিটি বাড়তি দামে পণ্য কেনার প্রমাণ পায়। তদন্ত কমিটি বেলাল হোসেন সরকারসহ ২৯ জন কর্মকর্তাকে দায়ী করে।
এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেলের পশ্চিমাঞ্চলে তালা, বালতি, বাঁশি, ঝান্ডাসহ অন্যান্য পণ্য কেনায় দুর্নীতির প্রমাণ পায় আরেকটি তদন্ত কমিটি। সম্প্রতি জমা দেওয়া প্রতিবেদনে ১৭ কর্মকর্তার জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। এই তালিকায় পশ্চিমাঞ্চলের তৎকালীন সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক বেলাল হোসেন সরকারের নাম আছে। প্রতিবেদন বলছে, রেলের জন্য একেকটা তালা কেনা হয় ৫ হাজার ৫০০ টাকায়। বালতির দাম পড়েছে ১ হাজার ৮৯০ টাকা।
দুর্নীতি-অনিয়মের ব্যাপারে তাঁর অবস্থান জিরো টলারেন্স। যেখানেই অভিযোগ পাচ্ছেন, সেটার তদন্ত করা হচ্ছে। ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। গাড়ি মেরামতে অনিয়ম হয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম
চেষ্টা করেও বেলাল হোসেন সরকারের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। রেলের পশ্চিমাঞ্চলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক মুহাম্মদ রাশেদুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এই পদে যোগ দেওয়ার আগেই গাড়ি মেরামতসহ অন্য কেনাকাটা হয়েছে। তবে গাড়ি মেরামতের খরচ নিয়ে অডিট আপত্তি এসেছে। তিনি এই বিষয়ে কাজ করছেন। কেনাকাটায় সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।
রেলের প্রকল্পসংক্রান্ত নথিপত্র থেকে জানা গেছে, টঙ্গী-ভৈরব বাজার ডাবল লাইন প্রকল্পের আওতায় ১৪টি গাড়ি কেনা হয়। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৬১৯৩ নম্বরের গাড়িটি একেবারে নতুন, ২০১১ সালের মডেল। সাত বছর চলাচলের পরই ২০১৯ সালে মেরামতের জন্য পাঠানো হয়। মেরামতের মধ্যে ইঞ্জিন পরিবর্তনও আছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্র জানায়, মিতসুবিশি পাজেরো গাড়িটির নিবন্ধন নেওয়া হয় ২০১২ সালের মার্চে। গাড়িটির ইঞ্জিনক্ষমতা ২ হাজার ৪৭৭ সিসি।
রেলের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, যদি গাড়িটি আগুনে পুড়ে যায় কিংবা বড় ধরনের দুর্ঘটনায় পড়ে, তাহলেই কেবল সাত বছরের মাথায় এত বড় মেরামতের দরকার হতো। ইঞ্জিন পরিবর্তনের বিষয়টিও অস্বাভাবিক। আর খুচরা যন্ত্রাংশের যে দাম ধরা হয়েছে, তা মোটেই স্বাভাবিক নয়।
মেরামতের নথি বলছে, একটি রিকন্ডিশন্ড ইঞ্জিন কেনা ও তা গাড়িতে স্থাপনের জন্য ৫ লাখ ১০ হাজার ৪৯৮ টাকা বিল করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন গাড়ি মেরামত কারখানায় রিকন্ডিশন্ড ইঞ্জিনের দাম ও তা স্থাপনের বিষয়ে খোঁজখবর করে ওই বিল অস্বাভাবিক ঠেকেছে।
একটি নামীদামি মেরামত কারখানার ব্যবস্থাপক প্রথম আলোকে বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইঞ্জিনের টুকটাক যন্ত্রাংশ পরিবর্তন (ওভারহোলিং) করা হয়। এতে এক লাখ টাকার কম খরচ হয়। বাজারে দেড় থেকে তিন লাখ টাকার মধ্যে পাজেরোর পুরোনো ইঞ্জিন পাওয়া যায়। একটি নতুন গাড়ির ইঞ্জিন ১০ বছরের আগে পরিবর্তনের নজিরও খুব কম।
সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে, নিবন্ধন নেওয়ার পর মোটরযানের কোনো কারিগরি, অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক পরিবর্তন করতে হলে বিআরটিএতে আবেদন করে অনুমোদন নিতে হবে। রেলের উল্লেখিত গাড়িটির ইঞ্জিন পরিবর্তনের বিষয়ে কোনো আবেদন জমা পড়েনি।
চার চাকায় চার সেট (প্রতি সেট দুটি) ব্রেক সু থাকে। রেলের ওই পাজেরোর জন্য প্রতি সেট ব্রেক সু কেনা হয় ৩৯ হাজার ৯৮৫ টাকায়। সব মিলিয়ে চার সেট ব্রেক সু কেনা হয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৪০ টাকায়।
রাজধানীর মেরামত কারখানা ঘুরে দেখা গেছে, বেশি ব্যবহৃত ব্রেক সুর দাম সাড়ে ৬ হাজার টাকা। ভালো মানের ব্রেক সু পাওয়া যায় সর্বোচ্চ সাড়ে ১৩ হাজার টাকায়।
এয়ার ক্লিনার ফিল্টারের বাজারদর ৭০০ থেকে ২ হাজার ১০০ টাকার মধ্যে। কিন্তু রেলের পশ্চিমাঞ্চলের ওই গাড়িতে ২৫ হাজার ৭৯০ টাকায় দুটি এয়ার ক্লিনার ফিল্টার লাগানোর বিল করা হয়েছে। প্রতিটির দাম পড়েছে ১২ হাজার ৮৯৫ টাকা।
দুটি মবিল ফিল্টার লাগানোর বিল করা হয়েছে ৫১ হাজার ৯৯২ টাকা। বাজারে ৯০০ টাকায় প্রতিটি মবিল ফিল্টার পাওয়া যায়। এ ছাড়া প্রতিটি ডিজেল ফিল্টারে ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার ৪৮৭ টাকা। অথচ বাজারে এগুলোর দাম ৮৫০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকার মধ্যে।
একটি ক্লাচপ্লেট কেনা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৫ টাকায়। অথচ বাজারে ৯ থেকে ১৪ হাজার টাকায় ভালো মানের ক্লাচপ্লেট পাওয়া যায়। পপুলার স্যাল্টের দুটি কলকির দাম পড়েছে ২৯ হাজার ৯৮৮ টাকা। বাজারে প্রতিটি রিকন্ডিশন্ড কলকির দাম সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা। গিয়ার বক্সের একটি মাউন্টেন লাগানো হয়েছে ১৮ হাজার ৯৯৩ টাকায়। অথচ বাজারে এগুলো পাওয়া যায় সাড়ে ৮ থেকে ১২ হাজার টাকায়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক এই বিষয়ে বলেন, জুনের মধ্যে খরচ করতে হবে—এমন একটা তাড়া সরকারি কার্যালয়গুলোতে আছে। ছোট ছোট কেনাকাটার মাধ্যমে এই সুযোগে কিছু কর্মকর্তা লাভবান হয়ে থাকেন। কিন্তু একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে ছোট ছোট এমন অনিয়ম যোগ করলে অনেক বড় হয়ে যায়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া না হলে তা বন্ধ হবে না।