রূপগঞ্জের চনপাড়া বস্তিকে ঘিরে নতুন চক্র ‘খড় পার্টি’

  • দুই বছরে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দুই শতাধিক নারীকে ফাঁদে ফেলে স্বর্ণালংকার, মোবাইল ফোন ও নগদ টাকা কেড়ে নিয়েছে ‘খড় পার্টি’।

  • যাতায়াতের দিক থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় চনপাড়া গ্রামে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত অনেকে আশ্রয় নেন।

প্রতারক চক্রের ফাঁদ, কৌশল ও প্রতারণার ধরন বুঝে কারও নাম হয় অজ্ঞান পার্টি, কেউ-বা মলম পার্টি, কারও পরিচয় সালাম পার্টি বা ধাক্কা পার্টি। এ রকম বাহারি সব নামের ভিড়ে আরও একটি নতুন নাম যুক্ত হয়েছে, তারা ‘খড় পার্টি’। তারা মূলত নারীদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে। খড় পার্টির তিন সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানতে পেরেছে, রাজধানী এবং আশপাশের এলাকায় এ ধরনের ৪০টি দল সক্রিয়। এই চক্রের সবার আস্তানা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার চনপাড়া গ্রামে।

পুলিশ জানায়, সাধারণ পথঘাটে বিপদগ্রস্ত সেজে কোনো নারীর কাছে সহায়তা চেয়ে আলাপ শুরু করেন খড় পার্টির সদস্যরা। নিখুঁত অভিনয় আর কথার মায়াজালে ফেলে ওই নারীকে ফাঁদে ফেলেন তাঁরা। পরে নারীর কাছে থাকা নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার, মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে পালিয়ে যান।

চনপাড়া গ্রাম আয়তনে খুব ছোট হলেও লাখখানেক লোকের বাস, যাঁদের বেশির ভাগই স্থানীয় বাসিন্দা নন। সেখানে খড় পার্টি, মলম পার্টিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতারক চক্রের সদস্যরা বসবাস করেন।
আবির হোসেন, সহকারী পুলিশ সুপার, নারায়ণগঞ্জ

রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় গত বৃহস্পতিবার এক নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে এই চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁরা হলেন সোহেল মিয়া (২৬), মো. সাগর (৩৫) ও আল আমিন (২৬)। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অভিনব প্রতারণার বিষয়টি জানতে পেরেছে পুলিশ। এই চক্রই গত দুই বছরে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দুই শতাধিক নারীকে ফাঁদে ফেলে স্বর্ণালংকার, মোবাইল ফোন ও নগদ টাকা কেড়ে নিয়েছে।

হাতিরঝিল থানা ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও অঞ্চলের অধীন। এই অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার হাফিজ আল ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, চক্রটি নতুন, তাদের কৌশলও অভিনব। রাজধানীর পাশাপাশি মুন্সিগঞ্জ এবং গাজীপুর শহরে প্রায় দুই বছর ধরে তারা সক্রিয়। চক্রের তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে, রূপগঞ্জ উপজেলার চনপাড়া গ্রামের চনপাড়া বস্তিতে চক্রের ৪০টি দল আছে। একেকটি দলের সদস্য তিনজন।

চক্রের নাম কেন ‘খড় পার্টি’

চক্রের নাম কেন খড় পার্টি, তা নিয়ে রূপগঞ্জের স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ দুই ধরনের বক্তব্য দিয়েছে। পুলিশের তেজগাঁও অঞ্চলের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, বাতাসে যেমন ‘খড়’ উড়ে যায়, এক স্থানে থাকে না, ঠিক তেমনি এই চক্রের সদস্যরা কাজ শেষে দ্রুত ‘খড়কুটোর’ মতো হারিয়ে যান। যে কারণে তারা খড় পার্টি।

রূপগঞ্জের চনপাড়া গ্রাম ও সেখানকার বস্তিতে এই চক্রের যাঁরা থাকেন, তাঁদের কেউই স্থানীয় বাসিন্দা নন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে তাঁরা বস্তিতে ভাসমান মানুষ হিসেবে আশ্রয় নিয়েছেন। কয়েক বছর ধরে সেখানে থাকলেও স্থানীয় লোকজন তাঁদের খড়কুটোর মতো মনে করে। যে কারণে চক্রের সদস্যরা খড় পার্টি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

পুলিশ জানায়, এই চক্রের প্রধান চনপাড়া এলাকার আলী আজগর নামে এক ব্যক্তি। তাঁর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে চক্রের বেশির ভাগ সদস্য প্রতারণায় যুক্ত হয়েছেন। তিনি চক্রের সদস্যের কাছে ‘মুরব্বি’। তিনি আগে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণায় জড়িত ছিলেন। এখন খড় পার্টি চালাচ্ছেন। আজগর নিজে কোনো ‘অভিযানে’ গেলে যা আয় হয় তার ৬০ শতাংশ একাই নেন। বাকি ৪০ শতাংশ পান অন্য দুজন।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. শহিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ধরা পড়া চক্রের তিন সদস্যের মধ্যে সাগর আগে হোটেলে বাবুর্চির সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। আর সোহেল ছিলেন বাসচালকের সহকারী। এক বছর আগে তাঁরা আলী আজগরের মাধ্যমে প্রতারণায় জড়িয়ে পড়েন। আগে অন্য এলাকায় থাকলেও খড় পার্টির সদস্য হিসেবে যোগ দেওয়ার পর চনপাড়া বস্তিতে গিয়ে ওঠেন। আর চক্রের আরেক সদস্য আল আমিন স্বর্ণের ব্যবসা করেন। তিনি মাঠে ‘অভিযানে’ যান না। প্রতারণা করে পাওয়া স্বর্ণালংকার চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে কম দামে কিনে নেন। তিনি বলেন, খড় পার্টি চক্রের সবাইকে ধরার চেষ্টা চলছে।

রাজধানী এবং আশপাশের এলাকায় খড় পার্টি চক্রের ৪০টি দল সক্রিয়। মূলত নারীদের প্রলোভনের ফাঁদে ফেলেন চক্রের সদস্যরা।

যেভাবে এ চক্রের কথা জানা গেল

শাহবাগের ফুল ব্যবসায়ী এক নারী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) গত মঙ্গলবার মগবাজারে এক ব্যক্তির কাছে যান ফুল বিক্রির টাকা আনতে। সেখানে বিপণিবিতান বিশাল সেন্টারের কাছে এক তরুণ নিজেকে মিষ্টি দোকানের কর্মী পরিচয় দিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। কথা বলার একপর্যায়ে ওই তরুণ নিজের সমস্যার কথা বলেন। একপর্যায়ে বেতন না পাওয়া এবং হাতে টাকা না থাকার কথা বলেন। তবে তাঁর কাছে মিষ্টি তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা পাঁচ পাউন্ড স্যাকারিন রয়েছে। যার বাজারদর ৮০ হাজার টাকা। এই স্যাকারিন বিক্রিতে ওই নারীর সহায়তা চান তরুণ। দুজনের কথোপকথনের মধ্যে আরও এক ব্যক্তি সেখানে এসে হাজির হন। তরুণের সমস্যার কথা শুনে তিনিও সহযোগিতা করতে আগ্রহ দেখান। একপর্যায়ে ওই তরুণ প্রস্তাব দেন স্যাকারিন বিক্রি করে দিতে পারলে ওই নারীকে ১০ হাজার টাকা দিতেও তাঁর আপত্তি নেই।

ওই নারী ও বিপদগ্রস্ত তরুণের কথোপকথনের মাঝে এসে যোগ দেওয়া ব্যক্তিটি পাশের একটি মিষ্টির দোকান খুঁজে বের করেন। সে দোকান থেকে একজন এসে স্যাকারিন পরীক্ষা করে জানান, পণ্যের মান খুবই ভালো। তবে ৭৮ হাজার টাকার বেশি দাম দিতে পারবেন না। বিপদগ্রস্ত তরুণ তখন স্যাকারিন বিক্রি করে টাকা নিয়ে আসার জন্য ওই নারীকে অনুরোধ করেন। যেহেতু অনেক টাকার বিষয়, সে জন্য ওই নারীর মোবাইল ফোন, স্বর্ণালংকার এবং ব্যাগ তাঁর জিম্মায় রেখে যেতে বলেন। তরুণকে বিশ্বাস করে তাঁর জিম্মায় ফোন, স্বর্ণালংকার এবং ব্যাগ রেখে দোকানে যান তিনি। কিন্তু সেখানে গিয়ে দোকানের ওই কর্মীকে আর খুঁজে পাননি। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দেখেন, ওই তরুণও সেখানে নেই। পরে বুঝতে পারেন, চক্রের তিন সদস্যের নিখুঁত অভিনয়ে তিনি প্রতারিত হয়েছেন। পরে বৃহস্পতিবার হাতিরঝিল থানায় অজ্ঞাতপরিচয় তিন তরুণের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি।

সরেজমিন চনপাড়া

রূপগঞ্জের মূল ভূখণ্ড থেকে চনপাড়া গ্রাম অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। তিন দিকে নদী ও এক দিকে খালবেষ্টিত এই গ্রামে লাখখানেক লোকের বাস। গ্রামের বড় অংশজুড়েই বস্তি। সড়কপথে এই গ্রামে ঢুকতে হলে ডেমরা হয়ে বালু নদের ওপর নির্মিত সেতু পার হতে হয়। ফলে গ্রামে প্রবেশের রাস্তা কার্যত একটি। যাতায়াতের দিক থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এই গ্রামে ছিনতাই, মলম পার্টি, ডাকাতিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত অনেকে আশ্রয় নেন বলে জানান নারায়ণগঞ্জের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা।

বিভিন্ন সময় চনপাড়া গ্রামে অভিযানে গিয়ে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে পুলিশকে। এর মধ্যে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার এক আসামিকে চনপাড়া থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে গিয়ে প্রতিরোধের মুখে পড়ে। একপর্যায়ে বস্তির লোকজন পুলিশকে ঘেরাও করে আসামি ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

নারায়ণগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার আবির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, চনপাড়া গ্রাম আয়তনে খুব ছোট হলেও লাখখানেক লোকের বাস, যাঁদের বেশির ভাগ স্থানীয় বাসিন্দা নন। সেখানে খড় পার্টি, মলম পার্টিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতারক চক্রের সদস্যরা বসবাস করেন। অভিযানে গেলে বিভিন্ন সময় বাধার মুখেও পড়তে হয়। সেখানে সাত থেকে আট হাজার নারী ও শিশু জড়ো হতে সময় লাগে মাত্র দুই মিনিট। ফলে অপরাধীদের ধরা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তবে আসামি ধরতে এখন সেখানে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।

এই প্রতিবেদক বৃহস্পতিবার দুপুরে চনপাড়ায় গিয়ে বস্তি ও এর আশপাশের এলাকায় খড় পার্টির তৎপরতা নিয়ে কথা বলতে চাইলে কয়েকজন ঘিরে ফেলেন। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তাঁরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এ সময় দু-তিনজন ব্যক্তি এই এলাকা থেকে দ্রুত বেরিয়ে যেতে বলেন।

পরে রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এবং চনপাড়ার বাসিন্দা বজলুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন এই প্রতিবেদক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন সময় এ ধরনের প্রতারণার কথা শুনেছেন। তাঁর এলাকায় বসবাসকারী অনেকেই এ ধরনের প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। তবে কারা জড়িত এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য তাঁর কাছে নেই। একপর্যায়ে বলেন, এসব নিয়ে কথা বলতে চান না তিনি।