নিবন্ধন করে ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা কিনে জুয়ায় অংশ নিতে হয়।
টাকার লেনদেন হয় এমএফএস ও ব্যাংক কার্ডের মাধ্যমে।
সিআইডি বলছে, জুয়ার টাকা বিদেশে পাচার হয়।
ফাঁদে পড়ে টাকা খোয়াচ্ছেন তরুণেরা।
বাংলাদেশে জুয়ার আসর চালানো একটি ওয়েবসাইটের খোঁজ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারা বলছে, সাইটটি পরিচালনা করা হয় রাশিয়া থেকে। এটি চালাচ্ছেন তিন বাংলাদেশি যুবক। তাঁরা রাশিয়া থাকেন।
জুয়ার সাইটটির নাম প্রকাশ করা হলো না। গতকাল শুক্রবার এতে প্রবেশ করে দেখা যায়, আইসিসির টি–২০ ওর্য়াল্ড কাপ, ইউরোপীয় ফুটবল লিগ, ক্রিকেট লিগসহ বিভিন্ন ধরনের খেলায় বাজি ধরার ব্যবস্থা আছে। চাইলে যে কেউ ক্যাসিনোও খেলতে পারেন। ওয়েবসাইটের পাশাপাশি তাদের মুঠোফোন অ্যাপও রয়েছে।
বাংলাদেশি তিন যুবক রাশিয়া থেকে জুয়ার ওয়েবসাইট পরিচালনা করছেন বলে জানিয়েছে সিআইডি। জড়িত সন্দেহে ছয়জনকে গ্রেপ্তার।
ওয়েবসাইটটিতে বলা হয়েছে, যাঁরা বাজি ধরতে আগ্রহী, তাঁদের প্রথমে নিবন্ধন নিতে হবে। খেলার জন্য অনুমোদনহীন ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনতে হবে। ওয়েবসাইটে কয়েকজন মিলে জুয়ার আসরও বসানো যায়। পুরো লেনদেন হয় অনুমোদনহীন ভার্চ্যুয়াল মুদ্রায়।
সিআইডি বলছে, এই ওয়েবসাইটে জুয়া বা ক্যাসিনো খেলতে ২০০ থেকে ৪০০ টাকায় ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা কিনে খুলতে হয় একেকটি ‘অ্যাকাউন্ট’। টাকা লেনদেন হয় মুঠোফোনে আর্থিক সেবা বা এমএফএস, মোবাইল ব্যাংকিং অথবা ব্যাংক কার্ডের মাধ্যমে। জুয়ায় জিতলে ভার্চ্যুয়াল মুদ্রার বিপরীতে নগদ টাকা ওঠানো যায়।
বাংলাদেশের আইনে জুয়া নিষিদ্ধ। অনলাইন জুয়া বা ক্যাসিনো খেলার ফাঁদে পড়ে টাকা খোয়াচ্ছেন তরুণেরা। তাঁদের একজন ঢাকার একটি বিপণিবিতানের ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নিয়মিত বিভিন্ন অনলাইন সাইটে জুয়ায় অংশ নেন। তবে খুব কম সময় জিততে পেরেছেন। অনেক টাকা খুইয়েছেন। তিনি বলেন, এটা একটা নেশার মতো।
রাশিয়ায় বসে বাংলাদেশে যে জুয়ার সাইটটি চালানো হয়, সেটির সঙ্গে জড়িত একটি চক্রের ছয় সদস্যকে ১৭ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। এ ঘটনায় রাজধানীর পল্টন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, এই জুয়াড়ি চক্রের টাকা লেনদেনের তথ্যের সূত্র ধরে পাঁচটি ব্যাংক হিসাব ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সাতজন এজেন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। এজেন্টদের লেনদেনের তথ্য খতিয়ে সিআইডি দেখেছে, একেক জন এজেন্ট প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০ লাখ টাকা জুয়াড়ি দলের পাঁচটি ব্যাংক হিসাবে জমা করেছেন। সিআইডি বলছে, এ টাকা পরে রাশিয়ায় পাচার হয়েছে।
সিআইডি সূত্র জানায়, জুয়ার সাইটটি দেশে বাংলা ভাষায় পরিচালিত হয়। তবে এর ডোমেইন নিবন্ধন রাশিয়া থেকে নেওয়া। জুয়ায় অংশগ্রহণকারীদের সার্বক্ষণিক সেবা দিতে এই সাইটের রয়েছে নিজস্ব কর্মী দল। প্রায় এক বছর ধরে সাইটটি সক্রিয়। বাংলাদেশে এই সাইটের মাধ্যমে জুয়ার আসর বসানো ও অর্থ পাচারের সঙ্গে ৫০ জনের মতো লোক জড়িত।
সিআইডির তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, রাশিয়া থেকে জুয়ার ওয়েবসাইটটি যাঁরা পরিচালনা করছেন, তাঁদের নাম ও পরিচয় পাওয়া গেছে। একজনের বাবা-ভাইও এই জুয়াড়ি চক্রের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। তাঁদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক কামরুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, দেশে অনলাইন জুয়া ও ক্যাসিনোর বিস্তার ঘটেছে। তরুণেরাই এই খেলায় বেশি আসক্ত হচ্ছেন। তিনি বলেন, অনলাইন জুয়া বা ক্যাসিনো খেলা চলছে এ রকম অনেকগুলো সাইট চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের লেনদেনের তথ্যও পাওয়া গেছে। এসব সাইটের মাধ্যমে প্রতি মাসে প্রায় ২৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকায় কয়েক মাস ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিভিন্ন ক্লাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় ক্যাসিনো ও জুয়া খেলা। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনলাইনে জুয়া খেলা বন্ধ হয়নি। সমস্যা হলো একটি সাইট বন্ধ করলে নতুন করে আরেক সাইট খুলে আবার জুয়া শুরু হয়। রাশিয়া থেকে পরিচালিত সাইটটির কাছাকাছি নামে বেশ কয়েকটি সাইট পাওয়া যায়। এসব সাইটেও জুয়া খেলা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, অনেক অপরাধ এখন অনলাইন মাধ্যমে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত নজরদারি নেই। পুলিশ মাঝেমধ্যে দু-একজনকে গ্রেপ্তার করে। তবে মূল হোতারা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এসব ওয়েবসাইট খুলে যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালানো না যায়, সে জন্য নিয়মিত নজরদারি ও ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।