মন্ত্রী–সাংসদদের তদবির

রাজনীতির শিকার আন্তনগর ট্রেন

আন্তনগর ট্রেনগুলো কার্যত ‘লোকাল’ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চলতি বছর এসব ট্রেনের ১২টি যাত্রাবিরতি (স্টপেজ) দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। আরও ২৭টি যাত্রাবিরতির জন্য মন্ত্রী ও সাংসদদের চিঠি রেল সদর দপ্তরে পড়ে আছে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ  সরকার ক্ষমতায় আসার পর আন্তনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতির সংখ্যা বাড়ানো শুরু হয়। গত ছয় বছরে আন্তনগর, মেইল ও ডেমু ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেওয়া হয়েছে ২৯টি। এর মধ্যে চলতি বছরেই দেওয়া হয়েছে ১২টি যাত্রাবিরতি। যাত্রাপথে ঘন ঘন ট্রেন থামায় আন্তনগর ট্রেনের পরিচালন সময় বেড়ে যাচ্ছে। এতে যাত্রীরা বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ।

এ বছর ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মহানগর এক্সপ্রেস, গোধূলী ও প্রভাতী, ঢাকা-কিশোরগঞ্জের এগার সিন্দুর, ঢাকা-নোয়াখালীর উপকূল, ঢাকা-সিলেটের উপবন ও কালনীর যাত্রাবিরতি বাড়ানো হয়। এ ছাড়া চলতি বছরে আরও তিনটি মেইল ও একটি ডেমু ট্রেনের যাত্রাবিরতি বাড়িয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। রেল কর্মকর্তাদের মতামত উপেক্ষা করে এই সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর করার অভিযোগ উঠেছে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, সর্বশেষ কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার গুণবতী স্টেশনে আন্তনগর ট্রেন গোধূলী এবং মহানগর প্রভাতীর নতুন স্টপেজ করার আদেশ জারি হয়েছে। যাত্রী ওঠানো-নামানোর জন্য কুমিল্লার মফস্বল এলাকার এই স্টপেজে ইতিমধ্যে জনপ্রিয় ট্রেন দুটি ৫ অক্টোবর থেকে থামছে। স্টেশনটি রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হকের নির্বাচনী এলাকা।

জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাপরিচালক কাজী মো. রফিকুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, সবকিছু বিবেচনা করে স্টপেজ বাড়ানোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যাত্রীদের সুবিধার জন্য এটা করা হয়েছে।

রেলের দায়িত্বশীল দুই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে বলেন, এক নগর থেকে আরেক নগরে যাত্রীদের পৌঁছানোর জন্য এরশাদ সরকার আন্তনগর ট্রেন চালু করেছিল। শুরুর দিকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বা সিলেটে চলাচলের সময় মাঝপথে কুমিল্লা বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আন্তনগর ট্রেন যাত্রাবিরতি করছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালের পর স্টপেজ বাড়ানো শুরু হয়। বর্তমান সরকারের আমলে উপজেলা শহর কিংবা মফস্বল এলাকায় আন্তনগর ট্রেনের স্টপেজ দেওয়া শুরু হয়েছে। ফলে আন্তনগর ট্রেনের আবেদন ও গুরুত্ব হারিয়ে যাচ্ছে।

ইউজিসি অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম নিয়মিত রেলভ্রমণ করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মফস্বলের স্টেশনে আন্তনগর ট্রেনের স্টপেজ করা হয়েছে। যে জনপ্রতিনিধি বা মন্ত্রী বা সাংসদ এ কাজ করেছেন, তিনি জনগণের কাছে মোটেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন না। বরং সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে চলেছেন তিনি। 

৬ বছরে ২৯ যাত্রাবিরতি
বর্তমান সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় আন্তনগর ট্রেন তূর্ণা, প্রভাতী, গোধূলী, জয়ন্তিকা, উপকূল, পাহাড়িকা, উদয়ন, পারাবতসহ বিভিন্ন ট্রেনের যাত্রাবিরতি বাড়ানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ট্রেনের যাত্রাবিরতি বাড়ানো হলে জ্বালানি খরচ বাড়ে। সেই তুলনায় টিকিট বিক্রি না হলে লোকসান গুনতে হয়।

যেমন মহানগর প্রভাতী ও গোধূলীর স্টপেজ এর আগে ২০১৩ সালে কুমিল্লার লাকসাম করা হয়েছিল। এখন এ দুটি ট্রেন কুমিল্লার গুণবর্তী স্টেশনে থামছে। একইভাবে চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথের পাহাড়িকা এক্সপ্রেসের স্টপেজ করা হয়েছে হরসপুর, নাঙ্গলকোট ও কসবা স্টেশনে। ঢাকা-নোয়াখালী রেলপথে বজরা ও নাথেরপেটুয়া স্টেশনে উপকূল এক্সপ্রেসের স্টপেজ করা হয়। ঢাকা-সিলেট জয়ন্তিকার স্টপেজ মুকুন্দপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় করা হয়। চট্টগ্রাম-চাঁদপুর রেলপথে মেঘনার স্টপেজ নাঙ্গলকোট ও মধুরোড স্টেশনে করা হয়। এ ছাড়া আরও কয়েকটি আন্তনগর ও মেইল ট্রেনের স্টপেজ বাড়ানো হয়েছে।

জানা গেছে, বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা চলাচলের পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় মহানগর এক্সপ্রেসের যাত্রাবিরতি চেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন গত বছরের ২২ মার্চ। এরপর ১৫ ডিসেম্বর থেকে ট্রেনটি কসবায় নিয়মিত থামছে। মুজিবুল হক রেলপথমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৩ সালে মহানগর প্রভাতী ও গোধূলীর যাত্রাবিরতি দিয়েছিলেন কুমিল্লার লাকসাম জংশনে। এ ছাড়া সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার অভিপ্রায়ে তাঁর দপ্তর সিলেটের শমশেরনগর স্টেশনে আন্তনগর কালনীর যাত্রাবিরতি চেয়েছিল। ২০১৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে কালনী শমশেরনগর স্টেশনে থামছে।

আন্তনগর ট্রেন চলাচলের জন্য বিধিবদ্ধ ম্যানুয়েলের ১.৩১ নম্বরে বলা আছে, আন্তনগর ট্রেন স্বল্প সময়ে দূরের গন্তব্যে স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত দ্রুতগতিসম্পন্ন বিশেষ শ্রেণির ট্রেন। স্বাভাবিক কারণে এই ট্রেনের বিরতিসংখ্যা সীমিত থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন বা জংশন স্টেশন ছাড়া এই ট্রেনের যাত্রাবিরতি করা যাবে না। 

আরও ২৭ যাত্রাবিরতির জন্য চিঠি
রেলওয়ের নথি থেকে জানা গেছে, মন্ত্রী ও সাংসদেরা তাঁদের নির্বাচনী  এলাকায় আন্তনগর ও মেইল ট্রেন থামাতে রেলওয়েকে চিঠি দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ। তিনি ঢাকা-ভৈরব রেলপথের তিন জোড়া ট্রেনের জন্য পূবাইল স্টেশনে যাত্রাবিরতি চেয়েছেন। এ ছাড়া সাংসদ রেজাউল করিম নুরুন্দি স্টেশনে ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ বা ঢাকা-তারাকান্দি রেলপথের যেকোনো একটি ট্রেনের, হবিগঞ্জের সাংসদ মাহবুব আলী নোয়াপাড়ায় কালনী ট্রেনের, সাংসদ র আ ম উবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কালনী ও বিজয় এক্সপ্রেসের, সাংসদ খন্দকার আসাদুজ্জামান হেমনগর স্টেশনে যমুনা এক্সপ্রেসের, ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান ময়মনসিংহের বিদ্যাগঞ্জ স্টেশনে তিন জোড়া ট্রেনের যাত্রাবিরতি চেয়েছেন।

এ ছাড়া ঘোড়াশাল, গাজীপুর, শ্রীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, জয়দেবপুর, ঢাকার তেজগাঁও ঢাকা ও শ্যামপুরের বরইতলা, নেত্রকোনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রেনের যাত্রাবিরতি চেয়েছেন ওই সব এলাকার মন্ত্রী–সাংসদেরা।

পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রী ও সাংসদের আবদার মেটাতে গেলে বাংলাদেশে আন্তনগর ট্রেনের ধারণা পাল্টাতে হবে। এতে সব কটি লোকাল ট্রেনে পরিণত হবে এবং ধীরে ধীরে তা হচ্ছে।