ফরিদপুরের মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নের পশ্চিম পাড়া গ্রামে ৬২ জন সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সদস্যের খোঁজ পেয়েছে সিআইডি।
আগে যাঁদের ছাপরা ছিল, সেখানে আজ পাকা দালান। তিন বেলা যাঁদের ভাত জুটত না, সেই সব লোক বাজারে যান দু–তিন হাজার টাকা পকেটে নিয়ে।
চাকরি, ব্যবসা বা অন্য কোনো পরিশ্রমের আয়ে এমন পরিবর্তন হয়নি। মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অল্প সময়ের ব্যবধানেই এ অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন তাঁরা। এ ডিজিটাল প্রতারকেরা স্থানীয়ভাবে ‘টোপ পার্টি’র সদস্য হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।
ঢাকা মহানগরের একটি ডিজিটাল প্রতারণা মামলা তদন্ত করতে গিয়ে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পশ্চিম পাড়া গ্রামে ৬২ জন সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সদস্যের খোঁজ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে ফরিদপুর জেলা পুলিশের তদন্ত বলছে, ডুমাইনের পশ্চিম পাড়া গ্রামে প্রতারক চক্রের সদস্যসংখ্যা ৭৭। পাশের ডুমাইন গ্রাম মিলে এ সংখ্যা ৯৫ দাঁড়িয়েছে। আশপাশের গ্রাম ও এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছেন প্রতারক চক্রের সদস্যরা।
সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন বলেছে, ডুমাইনের পশ্চিম পাড়ার শাহারুপ শেখের বিরুদ্ধে ডিজিটাল প্রতারণার অভিযোগে মধুখালী থানায় দুটি মামলা থাকার তথ্য মিলেছে। এ ছাড়া ময়নাল শেখ, রতন শেখ, ওবায়দুল কাজী, সাগর কাজী, তপন শেখ, মেহেদী হাসান, মিঠুন শেখ, মিলন শেখ, আশরাফুল শেখ, ইলিয়াস শেখ, রিপন শেখ ও আবদুল কাদের শেখের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। মামলাগুলো সব ডিজিটাল প্রতারণার। ২০১৮ সাল থেকে গত মার্চ পর্যন্ত এ মামলাগুলো হয়েছে।
দুই বছর আগে ২০২০ সালের ১৮ ডিসেম্বর ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান ‘টোপ পার্টি’র সদস্যদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে একটি সমাবেশ করেন। ওই সমাবেশে টোপ পার্টির ৯৫ জন উপস্থিতও ছিলেন। সেদিন তাঁরা অপরাধের এ পথ থেকে ফিরে আসার শপথ নেন। তবে এলাকাবাসী বলছেন, যাঁরা অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁরা স্বাভাবিক জীবনে আসেননি।
পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, টোপ পার্টির উৎপত্তি ডুমাইনে হলেও তাঁদের নেটওয়ার্ক সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। মধুখালীর ডুমাইন বর্তমানে একটি অচ্ছুত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়েছে। অপরাধীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে এলাকাবাসীর উদ্যোগ দরকার। পুলিশও সব ধরনের সহায়তা করবে। অবশ্য টোপ পার্টি থেকে ফিরে আসা কয়েকজনের ভাষ্য, এখন অপরাধে জড়িত না থাকলেও ঢালাওভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য মামলায় আসামি করে তাঁদের হয়রানি করছেন।
সিআইডি বলেছে, প্রতারক চক্রের সদস্যরা কয়েক বছর ধরে মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলেন। এক বছর আগে রাজধানীর শাহজাহানপুর থানার একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে মধুখালীর পশ্চিম পাড়া গ্রামের ৬২ জন প্রতারকের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা বের করেন তাঁরা। গত ২৮ মার্চ তাঁদের বিরুদ্ধে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। অভিযোগপত্রভুক্ত ১৫ জনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকার প্রমাণ মিলেছে। এ মামলায় আরও ১০ জন সম্পৃক্ত রয়েছেন, যাঁদের বাড়ি ডুমাইনে। তবে পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা না পাওয়ায় তাঁদের অভিযোগপত্রভুক্ত করা হয়নি।
মধুখালীর ডুমাইন বর্তমানে একটি অচ্ছুত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়েছে। অপরাধীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে এলাকাবাসীর উদ্যোগ দরকার। পুলিশও সব ধরনের সহায়তা করবে।মো. আলিমুজ্জামান, পুলিশ সুপার, ফরিদপুর
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগের উপপরিদর্শক (এসআই) এমদাদুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ডুমাইনের পশ্চিম পাড়ার ৬২ জন লোক ডিজিটাল প্রতারণায় জড়িত। তাঁদের মধ্যে ৮ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাঁদের জবানবন্দিতে মোট ৬৪ জনের সম্পৃক্ত থাকার তথ্য পাওয়া যায়।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, অভিযোগপত্রভুক্ত ৬৪ জনের মধ্যে ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বাকিরা পলাতক।
মামলার কাগজপত্র ও তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রতারণার ফাঁদে ফেলে বীথিকা গড়াই নামের একজন গ্রাহকের ১ লাখ ৭ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গত বছরের ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর শাহজাহানপুর থানায় মামলা হয়। মামলায় কারও নাম উল্লেখ করেননি বীথিকা। তবে প্রতারণায় ব্যবহৃত দুটি নম্বর মামলায় ছিল। দুটি মুঠোফোনের কল ডিটেইলস রেকর্ডের (সিডিআর) সূত্র ধরে প্রথমে গ্রেপ্তার হন ইকবাল শেখ ও আবদুল কাদের শেখ। দুজনই মধুখালীর পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা। গত বছরের ২৮ মার্চ তাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তি দেন। এই দুজনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একে একে ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডিও
‘ফরিদপুরসহ আশপাশের জেলার অনেকে আগে থেকে ডিজিটাল প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। এ নিয়ে মামলা হয়েছে। এই ডিজিটাল প্রতারকদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে।শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম, বিকাশের কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান
অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, এই চক্রের সদস্য সোহান, ইকলাছ, ময়নাল ও খায়ের টাকার বিনিময়ে বিকাশের বিভিন্ন দোকানে টাকা পাঠানোর খাতার ছবি সংগ্রহ করেন। পরে তা প্রতারক চক্রের সদস্যদের কাছে পাঠানো হয়। এরপর প্রতারক চক্রের সদস্যরা নিজেদের দোকানদার পরিচয় দিয়ে ভুলে টাকা চলে গেছে বলে গ্রাহকের কাছে দাবি করেন। পরে গ্রাহকের বিকাশ নম্বর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। প্রতারণার ফাঁদে পড়া গ্রাহকেরা পিন নম্বর দিয়ে দেন। তখন প্রতারক চক্র বিকাশ নম্বর চালু করার ফাঁদ পেতে টাকা আদায় করে থাকেন।
ভুক্তভোগী বীথিকা গড়াই প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তো বুঝতেই পারিনি যে ডিজিটাল প্রতারকদের খপ্পরে পড়েছিলাম। একজন ফোন করে আমাকে বলেছিল, আপনার নম্বরে টাকা চলে গেছে। ভুল করে বিকাশ অফিসে ফোন করে আপনার নম্বর বন্ধ করে দিয়েছি। পরে আরেকটি নম্বর থেকে আমার মোবাইলে কল আসে। তখন বিকাশ নম্বর সচল করার জন্য আমার পিন নম্বর জানতে চায়। আমি তখন বলে দিয়েছিলাম। এভাবে আমি প্রতারকদের ফাঁদে পড়ি।’
তদন্ত প্রতিবেদনে সিআইডি আদালতকে বলেছে, প্রতারকেরা যেসব মুঠোফোন ব্যবহার করেন, তা ভুয়া। এই সিমগুলো সংগ্রহ করেন আসামি রমজান, সোহান ও ময়নাল।
বিকাশের কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফরিদপুরসহ আশপাশের জেলার অনেকে আগে থেকে ডিজিটাল প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। এ নিয়ে মামলা হয়েছে। এই ডিজিটাল প্রতারকদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। আমরা বলতে চাই, বিকাশ কোনো গ্রাহকের কাছে ওটিপি কিংবা পিন কোড জানতে চায় না। গ্রাহক যদি এ ব্যাপারে সচেতন থাকে, তাহলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই।’
এদিকে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ডিজিটাল প্রতারণার বেশ কিছু মামলা ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন।
একটি গ্রামে এতজন মানুষের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা স্বাভাবিক নয়। নিশ্চয় সেখানকার সামাজিক ও প্রশাসনিক নজরদারির অভাব রয়েছে।খন্দকার ফারজানা রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান
গত সোমবার ফরিদপুরের মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নে গিয়ে দেখা গেল, পশ্চিম পাড়া ও ডুমাইন গ্রামে নতুন নতুন বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে। যাঁদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল প্রতারণার অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ, তাঁরাই এসব বাড়ি তৈরি করছেন। কয়েক বছর আগেও তাঁদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। অপরাধীদের বেশির ভাগই মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হতে পারেননি বলে জানা গেছে।
এলাকাবাসীর কয়েকজনের অভিযোগ, ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যান অপরাধীদের মদদ দিয়ে থাকেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা কৃষক লীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. খুরশীদ আলম (মাসুম) বলেন, এ প্রতারক চক্রের বিস্তার ঘটেছে সাবেক চেয়ারম্যানের সময়কালে। তিনি বরং তাঁদের নির্মূল করার উদ্যোগ নিয়েছেন। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তিনিই উদ্যোগী হয়ে এলাকায় সমাবেশ করেন।
তবে ডুমাইন ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য শাহ্ আসাদুজ্জামান (তপন) বলেন, ‘আমি টোপ পার্টিকে মদদ দিই না। বরং আমার সময়কালের শেষ পর্যায়ে এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলাম বলেই গত ইউপি নির্বাচনে পরাজিত হই।’
ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান বলেন, ‘দুই চেয়ারম্যান (বর্তমান ও সাবেক) যদি ওদের নিয়া দল করা ছাইড়া দেয়, তাইলে সব ঠিক কইরা দেওয়া ওয়ান–টুর ব্যাপার।’
ফরিদপুরের মধুখালীর একটি গ্রামে এতসংখ্যক মানুষ কেন একই ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন, জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, একটি গ্রামে এতজন মানুষের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা স্বাভাবিক নয়। নিশ্চয় সেখানকার সামাজিক ও প্রশাসনিক নজরদারির অভাব রয়েছে। কারণ, সামাজিক নজরদারি কম থাকলে সেখানকার মানুষের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। তবে কেন একটি গ্রামে এত মানুষ অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন, তার কারণ অনুসন্ধানে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে পর্যালোচনা জরুরি। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত পদক্ষেপ লাগবে।