এস এ এম শফিক ডাক্তার দেখিয়ে ছেলের সঙ্গে সবে বাসায় ফিরেছেন। গাড়ি থেকে নামতেই শোনেন তাঁর অপেক্ষায় আছেন আবদুল হক নামের একজন। শফিক কখনো লোকটিকে দেখেছেন বলে মনে করতে পারেন না। কিন্তু লোকটি নাছোড়বান্দা। কাছে গিয়ে বলেন, শফিক ও তাঁর ছেলেদের জাতীয় পরিচয়পত্র করে দেবেন তিনি।
ঘটনাটি গত ২৪ অক্টোবরের। ঘটনাস্থল বনানী, ব্লক-বি, ২২ নম্বর ভবন। ওই ভবনের তিনটি ফ্ল্যাটে এস এ এম শফিক ও তাঁর তিন ছেলে থাকেন। আরেক ছেলে কানাডায়।
কথা হচ্ছিল এস এ এম শফিকের বড় ছেলে সৈয়দ ওমর ফারুকের সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর বাবা ও তাঁদের চার ভাইয়েরই জাতীয় পরিচয়পত্র আছে। মা ফিরোজা বেগম মাস পাঁচেক আগে কোভিডে ভুগে মারা গেছেন। তাঁরও জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল। কারওই জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন নেই। হঠাৎ অপরিচিত একজন কেন নতুন পরিচয়পত্র করে দেওয়ার জন্য জোরাজুরি করছেন, তাঁরা বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
একপর্যায়ে সৈয়দ ওমর ফারুকের ছোট ভাই সৈয়দ ওমর আযম লোকটিকে জেরা করতে শুরু করেন। কথাবার্তা অসংলগ্ন। তাঁরা তাঁকে নিয়ে বনানী থানায় যান। পুলিশ লোকটিকে তল্লাশি করে তাঁর কাছ থেকে সৈয়দ ওমর ফারুকের মৃত মা ফিরোজা বেগমের জাতীয় পরিচয়পত্র উদ্ধার করেন। পরিচয়পত্রটি নতুন। একই সঙ্গে পাওয়া যায় একটি চিরকুট, যেখানে তাঁদের বাবা ও চার ভাইয়ের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর রয়েছে। বনানী থানায় সৈয়দ ওমর আযম একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে চলে আসেন। কিন্তু পুলিশ লোকটিকে ছেড়ে দেয়।
তবে এই ঘটনার পর সপ্তাহখানেক পেরিয়ে গেলেও অপরিচিত ওই লোক ফিরোজা বেগমের মৃত্যুর পর কী করে তাঁর নামে নির্বাচন কমিশন অফিস থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র পেলেন, তার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আযম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ধারণা, আবদুল হককে দিয়ে মৃত ব্যক্তির নামে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজটি করিয়েছেন এস এ এম শফিকের পরিবারের কেউ। সেই ব্যক্তি কে, তা তাঁর জানা নেই।
সৈয়দ ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মায়ের নামে বনানীর ফ্ল্যাট ও বারিধারায় তাঁর বাবার একটি বাড়ি আছে। মায়ের মৃত্যুর পর সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণের জন্য তাঁরা কোনো কিছুই করেননি। তাই জাতীয় পরিচয়পত্রেরও প্রয়োজন পড়েনি।
উল্লেখ্য, গত বছর কুষ্টিয়ার একটি চক্র এম এম ওয়াদুদ মিয়ার জাতীয় পরিচয়পত্র হাতিয়ে নিয়ে তাঁর পৈতৃক জমি বিক্রি করে দেন। ওই ঘটনায় গ্রেপ্তার আছেন সাতজন।
সেপ্টেম্বরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) নির্বাচন অফিসের দুজন ডেটা এন্ট্রি অপারেটরসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে দ্বৈত পরিচয়পত্র পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ওই পরিচয়পত্র ব্যবহার করে তাঁরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেন। চট্টগ্রামে নির্বাচন কমিশনের একটি চক্রসহ ১৫ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে প্রায় চার হাজার রোহিঙ্গাকে জাতীয় পরিচয়পত্র করে দেওয়ার অভিযোগে।
মোট ২২টি কাজের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হয়। সরকারি সব অনলাইন সুবিধা পেতে জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স করা ও নবায়ন, পাসপোর্ট করা ও নবায়ন, সম্পত্তি কেনাবেচা, টিআইএন পাওয়া, বিয়ে ও তালাক নিবন্ধর, ই-পাসপোর্ট, ব্যাংক হিসাব খোলা ও ব্যাংকঋণ নেওয়া, সরকারি ভাতা তোলা, যেকোনো সহায়তা পাওয়া, বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর, বিও অ্যাকাউন্ট খোলা, ট্রেড লাইসেন্স, যানবাহন রেজিস্ট্রেশন, বিমা স্কিম, ই-গভর্নেন্স, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ, মোবাইল সংযোগ, শিক্ষার্থীদের ভর্তিসহ প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ কাজেই জাতীয় পরিচয়পত্র প্রয়োজন।
মৃত্যুর পর ফিরোজা বেগমের পরিচয়পত্র ইস্যু হওয়া প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়েছে। কমিশনের কমিউনিকেশন কনসালট্যান্ট শফিক আহমেদ হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো বার্তায় লিখেছেন, প্রতারক ব্যক্তির হাতে থাকা ফিরোজা বেগমের এনআইডির তথ্যগুলো সঠিক। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কোনো অফিস বা উপজেলা নির্বাচন অফিস থেকে এটি দেওয়া হয়নি। এনআইডির বিপরীতে যেকোনো ধরনের আবেদন, সংশোধন, হারিয়ে গেলে পুনঃ উত্তোলনের আবেদন করলে সব তথ্য কমিশনের সার্ভারে সংরক্ষণ করা থাকে। গত ২০ অক্টোবর যে এনআইডিটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তা নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ থেকে সরবরাহ করা হয়নি। ২০০৭-০৮ সালে ছবিসহ ভোটার হওয়ার সময় যেসব তথ্য দিয়ে ফিরোজা বেগম ভোটার হয়েছিলেন, সেই তথ্যগুলোই জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের সার্ভারে সংরক্ষণ করা আছে। এমনকি ভোটার তালিকা বা এনআইডি তথ্যভান্ডার থেকে ফিরোজা বেগম মৃত—এই মর্মে তাঁর অবস্থান পরিবর্তনের কোনো আবেদনও করা হয়নি।
রাজধানীর বেসরকারি হাসপাতাল এ এম জেড থেকে দেওয়া মৃত্যুসনদ অনুযায়ী ফিরোজা বেগম মারা যান চলতি বছরের ২৯ মে। ওই সনদে তাঁর জন্মতারিখ ১৯৪৮ সালের ১ মার্চ। ফিরোজা বেগমের স্বামীর কাছে থাকা জাতীয় পরিচয়পত্রেও তাঁর জন্মতারিখ একই। মায়ের নাম সুফিয়া বেগম, বাসার ঠিকানা বাড়ি নং ২২, রাস্তা নং/নাম ২৩, ব্লক–বি, বনানী, ডাকঘর: বনানী–১২১৩, গুলশান, ঢাকা সিটি করপোরেশন। এই পরিচয়পত্রের নম্বর ১৩টি। এটি ইস্যু হয়েছিল ২০০৮ সালের ৬ এপ্রিল।
এ বছরের ২৪ অক্টোবর আবদুল হককে তল্লাশি করে যে পরিচয়পত্রটি পাওয়া গিয়েছে, সেখানেও ব্যবহার হয়েছে একই তথ্য। শুধু পরিচয়পত্রের নম্বর ১০টি। নতুন ইস্যু হওয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ১০টি বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন সূত্র। আবদুল হকের কাছ থেকে পাওয়া পরিচয়পত্রটি যাচাই করে এটি যে নকল নয়, সে সম্পর্কেও নিশ্চিত করেছে কমিশন।
ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো প্রথম আলোকে জানায়, ফিরোজা বেগমের পরিচয়পত্র হারিয়ে গেছে বলে থানায় জিডি করে থাকতে পারেন কেউ। এরপর তিনি নতুন একটি পরিচয়পত্রের আবেদন করতে পারেন। এর ভিত্তিতে নতুন কার্ড তৈরি হতে পারে। সুযোগ আছে আরও। জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে নির্বাচন অফিস থেকে দেওয়া স্লিপ দেখাতে হয়। স্লিপ, আইডি কার্ড, কোনো ডকুমেন্ট নেই বা এনআইডি কার্ড, ভোটার নম্বর, স্লিপের নম্বর না থাকলে সংশ্লিষ্ট উপজেলা, থানা, জেলা নির্বাচন অফিস থেকে ভোটার নম্বর সংগ্রহ করে এনআইডি রেজিস্ট্রেশন উইং/উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসারের কার্যালয়ে আবেদন করেও নতুন পরিচয়পত্র পাওয়া যায়।
বনানী থানার ওসি নূরে আযম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ফিরোজা বেগমের পরিচয়পত্র হারিয়ে গেছে—এমন কোনো জিডি বনানী থানায় হয়েছে বলে তাঁর জানা নেই। আবদুল হককে জিজ্ঞাসাবাদে কী জেনেছেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এক ব্যক্তি তাঁকে ফিরোজা বেগমের নামে পরিচয়পত্র করে দিতে বলেছিলেন। ওই ব্যক্তির পরিচয় দিতে পারেননি তিনি।
ফিরোজা বেগমের পরিবারের একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ তাঁদের জানিয়েছে, যে ব্যক্তিকে ওই কার্ড তাঁকে করতে দিয়েছিলেন, তাঁর ফোন নম্বর চাইলে আবদুল হক বলেছেন, তাঁর মুঠোফোন পানিতে পড়ে গেছে।
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতির সব কটি ঘটনাই তাঁরা তদন্ত করে দেখেছেন। যেখানেই নির্বাচন কমিশনের কারও সম্পৃক্ততা পেয়েছেন, শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করেছেন। সবশেষ ঢাকায় গোয়েন্দা বিভাগ দুজন ডেটা এন্ট্রি অপারেটরকে গ্রেপ্তার করে। ওই ঘটনাতেও তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটি প্রতিবেদনও দিয়েছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ চলছে।
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদাত হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এমন ঘটনা ঘটার কথা নয়। কিন্তু একেবারেই ঘটছে না, এমনটা বলার সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশনে লোকসংকট আছে। বেশ কিছু কাজ আউটসোর্সিং করতে হচ্ছে। তাঁদের সবার সততা, বিশ্বস্ততা কতটুকু, সেটা জানা কঠিন। তবে নির্বাচন কমিশন নজরদারি করছে বলেই অনেকেই ধরা পড়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।