এখানে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ সংগঠনের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ। ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছে পুলিশ। গতকাল কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে
এখানে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ সংগঠনের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ। ঘটনাস্থল  ঘিরে রেখেছে পুলিশ। গতকাল কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে

মুহিবুল্লাহ খুনে আরসাকে সন্দেহ

ইউএনএইচসিআর অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

রাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় অনেকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে কক্সবাজারের উখিয়ার নতুন রোহিঙ্গা শিবিরগুলো। এ সুযোগই নিয়েছিলেন খুনিরা। সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশে যেতে পেরেছিলেন তাঁরা। গত বুধবার রাতে খুনের ঘটনার ঠিক আগে মসজিদে এশার নামাজ আদায়ের পর কয়েকজনের সঙ্গে হেঁটে উখিয়ার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে নিজ কার্যালয়ের দিকে যাচ্ছিলেন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ। কার্যালয়ে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গুলি করে দ্রুত পালিয়ে যান অস্ত্রধারীরা। খুনে আরসা জড়িত বলে সন্দেহ করছেন মুহিবুল্লাহর স্বজনেরা।

প্রত্যক্ষদর্শী, রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা) ও শিবিরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে। এদিকে খুনের পর উখিয়া ও টেকনাফের শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সেখানকার পরিস্থিতিও থমথমে। এ অবস্থায় শিবিরগুলোর নিরাপত্তা আরও বাড়ানো হয়েছে।

বুধবার রাতে খুনের ওই ঘটনার সময় মুহিবুল্লাহর সঙ্গে ছিলেন তাঁর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ। তিনি খুনের ঘটনায় মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসাকে (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি। তারা আল ইয়াকিন নামেও পরিচিত) দায়ী করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে কথা হয় হাবিবুল্লাহের সঙ্গে। তিনি অভিযোগ করেন, নামাজ শেষে কার্যালয়ে যাওয়ার সময় তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন বেশ কয়েকজন মুসল্লি। সেই দলে থাকা কয়েকজন হঠাৎ পেছন থেকে মুহিবুল্লাহর সামনে এসে দাঁড়ান। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন বন্দুক বের করে মুহিবুল্লাহর বুকে গুলি করেন। এরপর আরও দুজন গুলি করেন। পরপর পাঁচটি গুলি করার পর তারা পালিয়ে যান।

হাবিবুল্লাহর দাবি, প্রথমে আরসা নেতা আবদুর রহিম প্রথমে মুহিবুল্লাহর বুকে গুলি করেন। এরপর লালু ও মোরশেদ নামের আরও দুজন গুলি করেন। তাঁরাও রোহিঙ্গা। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের মধ্যে এই তিনজনকে তিনি চিনতে পেরেছেন বলে দাবি করেছেন।

ঘটনার আরও দুজন প্রত্যক্ষদর্শী হামিদ হোসেন ও আলী আকবর জানান, হামলাকারীরা সংখ্যায় ২০ থেকে ২৫ জন হতে পারে। ৬ থেকে ৮ জন কার্যালয়ের ভেতরে ঢোকেন গুলি করার জন্য। আরও ১৪ থেকে ১৫ জন বাইরে অবস্থান করছিলেন। সবাই রোহিঙ্গা। অধিকাংশের হাতে ছিল স্থানীয়ভাবে তৈরি বন্দুক ও পিস্তল।

হামলাকারীরা আরসার চিহ্নিত সন্ত্রাসী হাবিবুল্লাহর এমন তথ্যের ভিত্তি কতটুকু, উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ এপিবিএনের (আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন) অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার নাইমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আসলে রোহিঙ্গা শিবিরে আরসা কিংবা আল ইয়াকিন নামে কোনো জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা নেই। তবে কিছু রোহিঙ্গা আরসা অথবা আল ইয়াকিনের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম ও সন্ত্রাসী কাজ করছে।

ঠিক কী কারণে মুহিবুল্লাহকে খুন করা হয়েছে, তা এখনো পরিষ্কার নয় বলে জানান ও পুলিশ সুপার নাইমুল হক। তিনি বলেন, বাইরে থেকে এসে হামলা করার প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। সম্ভবত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল অস্ত্রধারীরা।

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান ছিলেন মুহিবুল্লাহ। গত বুধবার রাতে লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন তিনি। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে থাকার সময় তিনি শিশুদের পড়াতেন। ইংরেজি ভাষাতেও তাঁর কিছুটা দক্ষতা ছিল। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা। তখন পরিবার নিয়ে অন্যদের সঙ্গে রাখাইন থেকে পালিয়ে উখিয়ার শিবিরের আশ্রয় নেন মুহিবুল্লাহ।

বিভিন্ন শিবিরের রোহিঙ্গা মাঝিরা (নেতা) বলছেন, প্রত্যাবাসন নিয়ে সন্ত্রাসী কয়েকটি গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল। এ কারণেও তিনি খুন হতে পারেন।

এদিকে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর খুনের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশ, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো গভীর শোক ও নিন্দা জানিয়েছে। খুনের ঘটনায় জড়িতদের তদন্তের আওতায় এনে তারা শাস্তির দাবি জানিয়েছে। এর মধ্যে ইউএনএইচসিআর এক বিবৃতিতে এই খুনের ঘটনায় অবিলম্বে তদন্ত শুরু করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

■ মুহিবুল্লাহর ভাই হাবিবুল্লাহর দাবি, খুনের ঘটনায় মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসা জড়িত। ■ পুলিশ বলছে, রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার কোনো তৎপরতা নেই।

নিজের সংগঠন এআরএসপিএইচের হয়ে মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের অধিকারের কথা আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরতেন। ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে আলোচনায় এসেছিলেন তিনি। ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের ফুটবল মাঠে কয়েক লাখ রোহিঙ্গার গণহত্যাবিরোধী মহাসমাবেশেরও অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। শিবিরের রোহিঙ্গাদের মধ্যে তাঁর বেশ জনপ্রিয়তা ছিল।

যেখানে খুন হন মুহিবুল্লাহ

লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের ডি ব্লকের জামে মসজিদ থেকে মুহিবুল্লাহর সাংগঠনিক কার্যালয়ের দূরত্ব ৬০ থেকে ৭০ গজ। বুধবারের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, সেদিন রাত সাড়ে আটটায় মুহিবুল্লাহ মসজিদে এশার নামাজ আদায়ের পর কার্যালয়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন ২০ থেকে ২৫ জন। এর মধ্যে মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহও ছিলেন। কার্যালয়ে ঢোকা মাত্র গুলি করা হয় তাঁকে। ওই কার্যালয় থেকে ৩০ গজ দূরেই মুহিবুল্লাহর ঘর।

গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশ আর ত্রিপলের ছাউনি ও বেড়ার ২০ ফুট লম্বা ও ৭ ফুট প্রস্থের কার্যালয়ের মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। সেখানে তখন পুলিশ সদস্যরা অবস্থান করছিলেন। কার্যালয়ের ভেতরে কোনো চেয়ার–টেবিল দেখা যায়নি। অন্য রোহিঙ্গারা জানান, মুহিবুল্লাহ মেঝেতে বসে দাপ্তরিক কাজ করতেন।

গতকাল দুপুরে মুহিবুল্লাহর ঘরে গিয়ে দেখা যায় শত শত রোহিঙ্গার ভিড়। রোহিঙ্গা নারীরা নিহত মুহিবুল্লাহর স্ত্রী নসিমা খাতুনকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। নসিমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা চালিয়েছেন তাঁর স্বামী। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আলোচনায় আসেন মুহিবুল্লাহ। এ কারণে প্রত্যাবাসনবিরোধী সন্ত্রাসীদের রোষানলে পড়েন তিনি। বিভিন্ন সময়ে তাঁর স্বামীকে হুমকি দেওয়া হতো। কিন্তু ভয় পেতেন না তিনি।

মুহিবুল্লাহ

এই হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত দাবি করে নসিমা বলেন, দোষীদের শাস্তি চান তিনি। স্বামী নিহত হওয়ার পর তিনিও নিরাপত্তাহীনতার ভুগছেন জানিয়ে আরও বলেন, চার মেয়ে ও চার ছেলে নিয়ে তিনিও এখন বিপদে আছেন। তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা প্রয়োজন।

মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর গতকাল সকাল থেকে আশ্রয়শিবিরের মোড়ে মোড়ে অবস্থান করতে দেখা গেছে এপিবিএনের সদস্যদের। শিবিরের ভেতরে-বাইরে কড়াকড়ি করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা মাঝিরা জানান, আশ্রয়শিবিরে দিনের বেলায় একরকম চিত্র থাকলেও রাতে চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই। পর্যাপ্ত রাস্তাও নেই। যেকোনো অপরাধ করে সহজে পালানো যায় পাহাড়ি এলাকা হওয়ায়।

আতঙ্কে সেবা সংস্থার কর্মীরাও

রোহিঙ্গাদের মানবিক সেবা দিচ্ছে দেড় শতাধিক দেশি-বিদেশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও)। শিবিরের ভেতরে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে হানাহানির ঘটনায় উদ্বিগ্ন বিভিন্ন এনজিও সংস্থার কর্মীরা। তবে করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে শিবিরে এনজিওদের কার্যক্রম সীমিত করা হয়েছে। এখন সেখানে চলছে জরুরি চাহিদার ত্রাণ, পানীয় জল সরবরাহ ও স্বাস্থ্যসেবার কাজ।

নাম না প্রকাশের শর্তে দুটি এনজিও সংস্থার দুজন কর্মকর্তা বলেন, খুনের ওই ঘটনার পর রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েছে। মুহিবুল্লাহ শান্তিপূর্ণভাবে প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের সংগঠিত করছিলেন। তিনি নিহত হওয়ায় প্রত্যবাসনবিরোধী পক্ষ আরও সক্রিয় হবে। এ ছাড়া সন্ত্রাসী তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে।

বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। রাখাইন থেকে ১৯৯১ সালে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালংয়ে ও টেকনাফের হ্নীলায় দুটি করে মোট চারটি শিবির ছিল। এরপর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা ঢলের পর টেকনাফে আরও ৬টি এবং উখিয়ার ২৪টি আশ্রয়শিবির হয়।

মুহিবুল্লাহর দাফন

গতকাল দুপুরে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে মুহিবুল্লাহর মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শাহীন মো. আবদুর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, গুলিতেই মুহিবুল্লাহর মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় লম্বাশিয়া ক্যাম্পের ডি-ব্লকের মসজিদে মরদেহ নেওয়া হলে সেখানে শত শত রোহিঙ্গার ঢল নামে। পরে জানাজা শেষে লাশ শিবিরের ভেতরে কবরস্থানে দাফন করা হয়। মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত রাত আটটা পর্যন্ত থানায় উখিয়া থানায় মামলা হয়নি।

মুহিবুল্লাহ খুনের ঘটনা নিয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (এপিবিএন) মো. আজাদ মিয়া গতকাল কক্সবাজারে জেলায় কর্মরত এপিবিএন কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে করেন।

খুনে জড়িত অস্ত্রধারীদের শনাক্ত করা গেছে কি না জানতে চাইলে আজাদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত শেষ হলে বলা যাবে কারা গুলি করেছে, কেন করেছে।