মোহাম্মদপুরের সাবেক কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানের গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠি। ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকায় আসেন। পরে মোহাম্মদপুর এলাকায় নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার সময় হাবিবুরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁর বাহিনীর লোকজন ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি করতেন। ১৯৭৫ সালে মোহাম্মদপুরে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত বাড়ি দখল করেন মিজান। ১৯৯৪ সালে তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। হাবিবুর মাদক কারবারে গঠিত বাহিনীর গডফাদার হিসেবে পরিচিত। তিনি অবৈধভাবে ২০ কোটি টাকা আয় করেছেন। মালিক বনেছেন ১৫টি ফ্ল্যাটের। তাঁর স্ত্রীর নামে আছে তিনটি ফ্ল্যাট।
অর্থপাচার মামলায় হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগপত্রে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। সম্প্রতি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক এস এম মিরাজ আল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে কাগজপত্রের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অর্থপাচার মামলায় হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। হাবিবুর রহমান অবৈধভাবে ২০ কোটি টাকার মালিক হন।
হাবিবুর রহমান গত বছরের ১১ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন। বর্তমানে তিনি কারাগারে।
সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, হাবিবুরের বাবা আবদুল মালেক মিয়া ঢাকায় জাতীয় চিড়িয়াখানায় ঝাড়ুসহ খাবার সরবরাহ করতেন। হাবিবুর দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় এসে বাবার ব্যবসায় যোগ দেন। সে সময় তিনি জড়িয়ে পড়েন নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। ছিনতাই করার সময় ধরা পড়ার পর বস্ত্রহীন অবস্থায় পাগলের মতো আচরণ করেছিলেন। পুলিশ ‘পাগল’ ভেবে তাঁকে ছেড়ে দেয়। তখন থেকে হাবিবুরের নাম পড়ে ‘পাগলা মিজান’। হাবিবুর একসময় গড়ে তোলেন ‘মিজান বাহিনী’। এই বাহিনীর লোকজন সিটি করপোরেশনের ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি করতেন। পরে আবার সেই ঢাকনা সিটি করপোরেশনের কাছে বেশি দামে বিক্রি করতেন। তখন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন হাবিবুর। মোহাম্মদপুরে দখল করেন আটকে পড়া পাকিস্তানিদের (বিহারি) পরিত্যক্ত বাড়ি। সেখানে তিনি বসবাস শুরু করেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে হাবিবুর মিরপুর–১০ নম্বরের এ–ব্লকে একটি মিষ্টির দোকান দেন। নাম দেন হাবিব সুইটমিট। এর পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৮০ সালে হাবিবুর গণপূর্তের ঠিকাদারি লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। টানা ১৪ বছর তিনি ঠিকাদারির ব্যবসা করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে বছিলায় একটি ইটভাটা দেন। নাম দেন এইচআরএম। বছিলায় হাবিব প্লাজা নামে একটি মার্কেট আছে তাঁর। লালমাটিয়ার স্বপ্নপুরি হাউজিংয়ে আছে তাঁর সাতটি ফ্ল্যাট। মোহাম্মাদপুরের আওরঙ্গজেব সড়কে আছে আরেকটি ফ্ল্যাট। রাজধানীর পল্টন এলাকার একটি পাঁচতলা ভবনের মালিক হাবিবুর। সেখানে আছে তাঁর ১০টি ফ্ল্যাট। হাবিবুর রহমান মিশুক অ্যান্ড কোম্পানির মালিক। এ ছাড়া তিনি ঢাকার হজ কাফেলা অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক।
সিআইডির কর্মকর্তা এস এম মিরাজ আল মাহমুদ অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, হাবিবুর মোহাম্মদপুরের অনিক সিদ্দিকী নামের এক ব্যক্তির পাঁচ কোটি টাকা মেরে দেন। হাবিব প্লাজার জায়গা বিক্রি বাবদ ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। টাকা নিলেও সম্পত্তি বুঝিয়ে দেননি তিনি। বছিলা বেড়িবাঁধ–সংলগ্ন খ্রিষ্টানপল্লির জমি দখল করে সেখানে ২০টি টিনশেড ঘর গড়ে তোলেন আসামি হাবিবুর। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরে সিটি করপোরেশনের সমবায় মার্কেটের ১৩৫টি দোকান বরাদ্দ দেওয়ার নামে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসার ভাগ নিতেন তিনি।
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এস এম মিরাজ আল মাহমুদ বলেন, হাবিবুরের স্ত্রী মনি রহমানের নামে তিনটি গাড়ি ও তিনটি ফ্ল্যাট পাওয়া গেছে। চারটি ব্যাংক হিসাবে তাঁর নামে ১৬ লাখ ৬৩ হাজার ৩৫৪ টাকা পাওয়া গেছে। করোনায় হাবিবুর রহমানের স্ত্রী মারা গেছেন। যে কারণে তাঁকে এই মামলার আসামি করা হয়নি।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, সাবেক কাউন্সিলর হাবিবুরের তিন ছেলে। বড় ছেলে হাবিব লন্ডনে পড়াশোনা শেষে ঢাকায় এসে ছোটখাটো ঠিকাদারি ব্যবসা করছেন। মেজ ছেলে ইছা হাবিব ও ছোট ছেলে মুছা অস্ট্রেলিয়ায় লেখাপড়া করে সেখানেই আছেন।