পুরান ঢাকার কাশ্মীরি টোলার সরু গলির ওপর ছোট একটা ভবনের তিনতলায় থাকেন হাসিনা বেগম। পুত্রবধূ হোসনে আরা তিনতলায় উঠতে উঠতে বললেন, শাশুড়ি আর তাঁর কপাল একই রকম। শ্বশুর মারা গেছেন অনেক বছর আগে, আর তাঁর স্বামী এখন থেকেও নেই।
হোসনে আরার স্বামী মো. হানিফ (মিঠু) পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের এসএস ট্রেডার্সের ছয় হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী। গত বছরের জানুয়ারিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত দোকানের মালিককে খুঁজে না পেয়ে হানিফকে জেলে পাঠিয়েছেন। দোকানটিও সিলগালা করে দেওয়া হয়েছিল তখন। এখন আর সিলগালা নেই, নাম বদলে দোকান চলছে।
ঘটনাটি ঘটে গত বছরের ২০ জানুয়ারি। মৌলভীবাজারের সাখাওয়াৎ ম্যানশনের প্রায় সব কটি দোকানে ওই দিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন র্যাবের তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম।
নথিপত্রে ম্যাজিস্ট্রেট লেখেন, এসএস ট্রেডার্স চীন থেকে শিশুখাদ্য, চকলেট, বিস্কুট ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করে বাজারে ছাড়ে। আমদানি করা এসব শিশুখাদ্যের বড় প্যাকেটের গায়ে মেয়াদোত্তীর্ণের যে তারিখ লেখা, তার চেয়ে ৬ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত বাড়িয়ে স্টিকার লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করছে। অভিযানের সময় দেখা যায় যে অভিযুক্ত ব্যক্তি সসের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর পুরোনো তারিখ মুছে ফেলার জন্য তারপিন দিয়ে ভিজিয়ে রেখেছেন।
সারোয়ার আরও লেখেন, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি মো. হানিফ প্রতিষ্ঠানের মালিক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের অপরাধ করে আসছেন। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে আমাদের শিশুসহ জনসাধারণ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারে। এ অপরাধ নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩–এর ২৯ ধারা মোতাবেক অপরাধ। মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯–এর ৭ ধারার সব পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে।’ আদালত তাঁকে ছয় লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন।
হোসনে আরার দাবি, এসএস ট্রেডার্সের মালিকের নাম মো. আবদুর এরশাদ ওরফে শান্ত। শেখ সাহেব বাজারে তাঁদের বাসার উল্টো দিকেই তিনি থাকেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাঁর স্বামীকে কারাগারে পাঠিয়েছেন, মালিককে ধরার কোনো চেষ্টাই করেনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর বিভাগে খোঁজ নিয়ে হোসনে আরার কথার সত্যতা পাওয়া যায়। ট্রেড লাইসেন্স অনুযায়ী দোকানটির মালিক এরশাদ।
মালিকের পরিবর্তে কর্মচারীকে কারাগারে পাঠিয়েছেন কি না, এ প্রশ্নের জবাবে র্যাবের সাবেক ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালিকের সঙ্গে কী সম্পর্ক, এখন মামলার কপি না দেখে বলা যাবে না। আইনত যাঁরা অপরাধ করেন, মালিক বা শ্রমিক যে–ই হোক না কেন—তাঁরা সবাই অপরাধী। অপরাধের সহযোগী। এ ক্ষেত্রে মালিকের শাস্তি বেশি হয়, কর্মচারীর কম হয়। আইনে এটা শাস্তিযোগ্য।’
মালিককে খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন কি না, জানতে চাইলে বর্তমানে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত এই কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেক সময় মালিক বলে, তারা কর্মী। আবার এখানে অনেক সময় যেটা হয়, প্রতিষ্ঠান একজনের নামে, কিন্তু সে আবার সাবলিজ দিয়ে দেয়। তখন মাল বিক্রি করে। বিভিন্ন স্তর থাকে। চেইন ধরে যেতে হয়। তাঁরা (কর্মচারীরা) জেনেশুনেই কাজটা করে।’
ট্রেড লাইসেন্স পরীক্ষা করেছিলেন কি না, এ প্রশ্নের জবাবে সারওয়ার আলম বলেন, তিনি ট্রেড লাইসেন্স পরীক্ষা করে দেখতেন। কর্মচারীদের শাস্তিও দিতে চাইতেন না। সারওয়ার বলেন, ‘ধরেন, একজন খুন করল, অন্য একজন পাহারা দিচ্ছে তখন, যে আসলে সরাসরি ফায়ার (গুলি ছুড়ল) করল, তার সঙ্গে সহযোগীও অপরাধী।’
দণ্ড ভোগ করা মো. হানিফের স্বজন বা সাখাওয়াৎ ম্যানশনের অন্য দোকানি কিংবা ভ্রাম্যমাণ আদালত যে দুজন সাক্ষীকে কাগজে-কলমে হাজির করেছেন, তাঁরা বলছেন, অন্য কথা। তাঁদের ভাষ্যমতে, ভ্রাম্যমাণ আদালত কাউকে কোনো কথা বলার সুযোগই দেননি। কথা বললেই জরিমানার পরিমাণ বাড়বে বলে হুমকি দিচ্ছিলেন। ট্রেড লাইসেন্স পরীক্ষা করলে হানিফের জেলে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।
এমনকি ওই দোকানের ভিজিটিং কার্ডেও এসএস ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী হিসেবে মো. আবদুর এরশাদের নাম লেখা। কয়েক বছর আগে হানিফ পাসপোর্ট করার জন্য তাঁর কাছ থেকে একটি প্রত্যয়নপত্র নিয়েছিলেন। ওই প্রত্যয়নপত্রেও এরশাদ লিখেছেন, মো. হানিফ তাঁর দোকানে ‘সেলসম্যান’ হিসেবে কর্মরত আছেন। তাঁর স্বভাবচরিত্র ভালো। তিনি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজে জড়িত নন।
হানিফের মা হাসিনা বেগম আইনের মারপ্যাঁচ বোঝেন না। তিনি প্রথম আলোকে ওই দিনের ঘটনা বর্ণনা করছিলেন, ‘সকালবেলায় মৌলভীবাজার গেছে। আমি আবার সেইসুম ছিলাম না। ভাইয়ের বাসায় গেছিলাম। বিকেলে বাসায় আসছি, শুনি, ঝামেলা হইছে। বোরকাও খুলি নাই তখন। পুতের বউ আর মেয়ের ঘরের নাতিরে নিয়া গেছি। কেঁচিগেট আটকানি। দেখতে দেয় না। অনেকবার বলেছি। পরে একপলক দেখেছি। আমার নাতি বলছে, “আমার মামার কুনু দোষ নাই।” সে দোকানের কর্মচারী, মালিক না। তার গালে ঠাস করে র্যাবের লোকেরা চড় মারছে, গাড়িতে উঠাইছে। আমি তখন অনেক কান্না করেছি। পরে নাতিরে গাড়ি থাইকা নামায়ে দিছে।’
হাসিনা বেগম বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত চলার সময় দোকানের কাছাকাছিই ছিলেন মালিকেরা। তাঁরা কেউ এগিয়ে যাননি। আশপাশের দোকানে খোঁজ নিলেও আদালত জানতে পারতেন, তাঁর ছেলে দোকানের কর্মচারী, মালিক নন। সেই খোঁজটুকুও নেয়নি কেউ। সেদিনই রাত দুইটার দিকে র্যাবের একটি গাড়ি ছেলেকে নিয়ে দোকানমালিকের বাসায় এসেছিল। মালিককে পায়নি। পরদিন তাঁর ছেলেকেই জেলে পাঠায়।
এই মামলায় ভ্রাম্যমাণ আদালত দুজনকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করেন। তাঁদের একজনের নাম ফারুকুজ্জামান (৪২) ও অন্যজন মো. শাকিব (২২)। ফারুকুজ্জামানের মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। শাকিবকে গত মঙ্গলবার পাওয়া যায় মৌলভীবাজারেই। তিনি বিভিন্ন দোকান থেকে পণ্য সরবরাহ করে টাকা তোলেন। সেদিনও টাকা তুলতে বেরিয়েছিলেন।
শাকিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দোকান থেকে টাকা তুলতে গেছিলাম পাশের মার্কেটে। আমার ঘাড়ের পিছে ধইরা আনছে। তারপর সই নিয়া ছাইড়া দিছে। পরে শুনি, আমি সাক্ষী।’
ঘটনার পর দোকানের মালিকপক্ষ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জরিমানা দিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে এনে দেবে। তাঁরা একজন আইনজীবীও নিয়োগ করেছিলেন। দুই মাস পর মো. হানিফ জামিনে ছাড়াও পান। আইনজীবীর পরামর্শমতো নিয়মিত হাজিরা দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
গত ডিসেম্বরে হাজিরা তারিখের আগে দুবার আইনজীবী তাঁকে আদালতে না যাওয়ার পরামর্শ দেন। তাঁকে আশ্বস্ত করেন এই বলে, এ মামলা শেষ। আর যেতে হবে না। এর মধ্যে হঠাৎ হানিফ জানতে পারেন, তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। আদালতে উপস্থিত হয়ে তিনি আত্মসমর্পণ করলে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন বিচারক।
হানিফকে আবারও জেলে যেতে হলো কেন, সে বিষয়ে জানতে কথা হয় আইনজীবী মো. রবিউল আলমের সঙ্গে । তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালতের রায়ই বহাল রেখেছেন।
হোসনে আরা এত কিছু বোঝেন না। ছয় হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী কী করে ছয় লাখ টাকা জরিমানা দেবেন, কী করে জেল থেকে ছাড়া পাবেন, এ ভাবনায় তিনি দিশেহারা। দোকানমালিক ও প্রতিবেশী আবদুর এরশাদ আর কোনো দায় নিতে চাইছেন না।
গতকাল বুধবার ফোন করা হলে এরশাদ বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেন। এসএস ট্রেডার্সের মালিক তিনি কি না, জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি বাসে আছি। কিছু শুনতে পাচ্ছি না।’