ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী এলমা চৌধুরীকে হত্যা করা হননি, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ির অসৌজন্যমূলক আচরণ ও মারপিট সহ্য করতে না পেরে এলমা আত্মহত্যা করেন। তাঁকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিয়েছেন স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ি।
প্রায় চার মাস তদন্তের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। এ মামলায় যেকোনো দিন আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেবে ডিবি।
ডিবির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিজিটাল-ফরেনসিক প্রমাণের পাশাপাশি আসামি ও অন্য সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ থেকে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, এলমা আত্মহত্যা করেছেন। তাঁকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিয়েছেন স্বামী ইফতেখার আবেদীন, শাশুড়ি শিরিন আমিন ও শ্বশুর মো. আমিন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এলমা আত্মহত্যা করেন।’
এলমার বাবা সাইফুল ইসলাম চৌধুরী গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে তাঁকে জানানো হয়েছে। তবে তিনি এখনো বিশ্বাস করেন, এলমাকে তাঁর স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি হত্যার পর আত্মহত্যার নাটক সাজিয়েছেন। ডিবি যদি তাঁর মেয়ের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়, তবে তিনি ‘নারাজি’ দেবেন।
প্রবাসী স্বামী ইফতেখার আবেদীন (৩৫) কানাডা থেকে দেশে ফেরার তিন দিনের মাথায় গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর এলমার (২৬) মৃত্যু হয়। তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখমের দাগ ছিল।
এলমার মৃত্যুর এক দিন পর বাবা সাইফুল রাজধানীর বনানী থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় এলমার স্বামী ইফতেখার আবেদীন, শাশুড়ি শিরিন আমিন ও শ্বশুর মো. আমিনকে আসামি করা হয়। এই তিনজন পারস্পরিক যোগসাজশে এলমাকে হত্যা করেছেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, গত ১৪ ডিসেম্বর ইফতেখার জানান, এলমা গুরুতর অসুস্থ। তাঁকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। স্ত্রী ও ভায়রাকে সঙ্গে নিয়ে সেদিন বিকেল পাঁচটার দিকে হাসপাতালে পৌঁছান সাইফুল। তিনি হাসপাতালের ট্রলিতে এলমার লাশ দেখতে পান। লাশের পাশে ছিলেন ইফতেখার ও তাঁর বাবা মো. আমিন। এ সময় তাঁদের আচার-আচরণ স্বাভাবিক ছিল না।
সাইফুল অভিযোগ করেন, বিয়ের পরপরই ইফতেখার ও তাঁর বাবা-মা এলমার লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে চান। রাজি না হওয়ায় তাঁরা এলমার চুল কেটে দেন। সাংসারিক নানা কাজের জন্যও এলমার ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হতো।
সুরতহাল প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সাইফুল মামলার এজাহারে লেখেন, এলমার নাকে, ওপরের ঠোঁটে, ঘাড়ে, গলার উপরিভাগে থুতনিতে, পিঠের ডান পাশে, দুই হাতে, দুই পায়ের বিভিন্ন জায়গায় জখমের কালচে দাগ ছিল। এ ছাড়া তাঁর বাঁ কানে আঘাত ছিল। দুই হাতের আঙুল কাটাছেঁড়া ছিল। পায়ের বুড়ো আঙুল ছেলা ছিল।
এলমার লাশের ময়নাতদন্ত করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন ও টক্সিকোলজি বিভাগের প্রভাষক ফারহানা ইয়াসমীন। তিনি লিখেছেন, মৃত্যুর ধরন বলছে, এলমা আত্মহত্যা করেছেন। ঝুলে থাকায় শ্বাসরোধে তিনি মারা যান। তবে তাঁর শরীরের নানা জায়গায় আঘাতের অসংখ্য দাগ রয়েছে।
এলমার মৃত্যুর পরপরই তাঁর স্বামী ইফতেখারকে গ্রেপ্তার করে বনানী থানা-পুলিশ। পরে মামলাটির তদন্তভার পায় ডিবি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইফতেখারকে চার দফায় রিমান্ডে নেয় ডিবি। তদন্তের অংশ হিসেবে তারা এলমার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনসহ অন্যান্য আলামত ও তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে।
ফ্রান্সে থাকাকালে ইফতেখার প্রথম বিয়ে করেন। এ সংসারে একটি কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। ২০২০ সালে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ইফতেখারের বিচ্ছেদ হয়।
পরে অ্যাপসের মাধ্যমে এলমার সঙ্গে ইফতেখারের পরিচয় হয়। পরিচয়ের ৮ দিনের মাথায় গত বছরের ২ এপ্রিল ইফতেখার-এলমার বিয়ে হয়।
এলমার সঙ্গে বিয়ের পর ইফতেখার কানাডায় চলে যান। কথা ছিল, তিনি এলমাকেও কানাডায় নিয়ে যাবেন।
তদন্তে ডিবি জানতে পারে, এলমার সঙ্গে বিয়ের দুই মাস পর ইফতেখার কানাডায় চলে যান। দেশে আসেন গত বছরের ১১ ডিসেম্বর। এই দম্পতি একে অন্যকে বিশ্বাস করতেন না। ১৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে এলমা ও ইফতেখারের মধ্যে ঝগড়া হয়। এলমা রাতেই স্বামীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইফতেখার বাড়ি থেকে বের হওয়ার সব পথ তালা দিয়ে বন্ধ করে দেন। একপর্যায়ে এলমা ছবির অ্যালবাম ভেঙে নিজের গলা কেটে ফেলার চেষ্টা করেন। তখন এলমাকে বেধড়ক মারধর করেন ইফতেখার।
পরদিন সকালে আবার দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়। এলমা জানিয়ে দেন, তিনি আর ইফতেখারের সঙ্গে থাকতে চান না। ইফতেখার নিজেদের শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। মিনিট দশেক বাদে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখেন দরজা লাগানো। চাবি দিয়ে লক খুলতে গিয়ে গৃহকর্মী দেখেন, দরজায় ছিটকিনি দেওয়া। পরে গাড়িচালককে সঙ্গে নিয়ে ইফতেখারের বাবা মো. আমিন দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেন। নিচ থেকে কুড়াল নিয়ে এসে দরজা কেটে তাঁরা ভেতরে ঢোকেন। ভেতরে ঢুকে দেখেন, গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় এলমার দেহ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আছে। এলমার পা উঁচু করে তুলে ধরেন ইফতেখার। গৃহকর্মী বঁটি দিয়ে ওড়না কেটে ফেলেন। এলমাকে পরে ধরাধরি করে গাড়িতে তোলা হয়। ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা এলমাকে মৃত ঘোষণা করেন।