মানসিক হাসপাতাল শুধু নামে

জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিমের মৃত্যুর পর বেসরকারি মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসার দুর্দশার চিত্রটি ব্যাপকভাবে সামনে আসে।

  • ঢাকায় অনুমোদিত বেসরকারি মানসিক হাসপাতাল ১৫টি।

  • অধিকাংশেই শর্তানুযায়ী চিকিৎসক ও নার্স নেই।

  • দেশে মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মাত্র ২৭০ জন।

জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিমকে হত্যার প্রতিবাদে ও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মোমবাতি প্রজ্বালন করেন ৩১তম বিসিএস ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের (এএসপি) সদস্যরা। গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে

দেশের প্রায় ১৭ শতাংশ মানুষের কোনো না কোনো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এর চিকিৎসায় পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল নেই। রয়েছে অবকাঠামো সংকট। সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতাল আছে দুটি, ঢাকা ও পাবনায়। সেখানেও নানা সমস্যা। বেসরকারি খাতের অবস্থা আরও শোচনীয়। তারা সরকারের কোনো শর্ত মানে না। মারধর তাদের অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি। আবার অনেক ক্ষেত্রে মানসিক চিকিৎসা ও মাদকাসক্তির চিকিৎসাকে তারা এক করে ফেলেছে।

ঢাকার এমনই একটি বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে গত সোমবার মারধরে মারা গেছেন পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিম। এই ঘটনার পর বেসরকারি ক্লিনিকে মানসিক চিকিৎসার দুর্দশার চিত্রটি ব্যাপকভাবে সামনে আসে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ঢাকায় সরকার অনুমোদিত বেসরকারি মানসিক হাসপাতাল আছে ১৫টি। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালই সরকারের দেওয়া লাইসেন্সের শর্তও মানছে না। শয্যাসংখ্যা অনুপাতে যে সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকার কথা, সেটা নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্য হাসপাতালই বাইরের চিকিৎসকদের (অন কল) ওপর নির্ভরশীল। এক-দুজন মেডিকেল অফিসার মূলত হাসপাতাল চালান।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশির ভাগ হাসপাতালে মানসিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নেই। রোগীদের চিকিৎসার নামে মারধরের অভিযোগ তো রয়েছেই। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শুধু ওষুধ নয়, এসব রোগীর নিয়মিত মানসম্পন্ন কাউন্সেলিং দেওয়ার দরকার হয়। তা দেওয়ার মতো জনবলও নেই।

গত বছর নভেম্বরে প্রকাশিত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৮-১৯ অনুযায়ী, দেশের দুই কোটির বেশি মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। শতকরা হিসেবে তা ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ইনস্টিটিউটের হিসাবে, দেশের সাড়ে ১৬ কোটির বেশি মানুষের জন্য এই মুহূর্তে মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন ২৭০ জন। আর কাউন্সেলিংয়ের জন্য সাইকোলজিস্ট রয়েছেন মাত্র ২৫০ জন।

হুমায়ুন রোডের ‘মন নিরাময়’ নামের হাসপাতালটি অনুমোদন নিয়েছিল মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র হিসেবে। কিন্তু সেখানেও মানসিক রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়

প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত জনবল কম থাকার সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল। এদের ওপর প্রয়োজনীয় নজরদারি নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে তাঁরা নিয়মিত নজরদারি করতে পারছেন না।

সরকার অনুমোদিত মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রের বাইরে রাজধানীতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমোদনপ্রাপ্ত মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্র আছে ১০৫টি। এ ধরনের অনেক প্রতিষ্ঠানও মানসিক রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে চিকিৎসার নামে রোগীকে মারধর করার অভিযোগও বেশি।

পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুল করিম যে হাসপাতালে মারা যান, সেটিও এমন একটি চিকিৎসাকেন্দ্র। মাইন্ড অ্যান্ড সাইকিয়াট্রিক অ্যান্ড ডি-অ্যাডিকশন হসপিটাল নামের এই প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো অনুমোদন নেই। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের লাইসেন্স নিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা দিয়ে আসছিল। অভিযোগ আছে, আনিসুলকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে ওই বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল।

আনিসুলের মৃত্যুর ঘটনায় করা হত্যা মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আনিসুলকে কারা মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে ভাগিয়ে নিয়েছেন, তাঁদের নাম পাওয়া গেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকায় সরকার অনুমোদিত ১৫টি বেসরকারি মানসিক হাসপাতালের ১৪টিই গড়ে উঠেছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চারদিক ঘিরে অর্থাৎ মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোড, বাবর রোড, শ্যামলী, আদাবর, মণিপুরিপাড়া, ফার্মগেট ও গ্রিন রোড এলাকায়। বাকি একটি বারিধারায়।

মানসিক রোগীর সঙ্গে বলপ্রয়োগ, তাঁর গায়ে হাত তোলা বা কোনোভাবেই মারধর করা যাবে না। রোগীকে মৌখিকভাবে শান্ত করতে হবে। তাতে কাজ না হলে কৌশলে একটি কক্ষে আটকে রাখতে হবে।
হেলালউদ্দিন আহমেদ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলালউদ্দিন আহমেদ পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুল করিম মৃত্যুর ঘটনায় করা তদন্ত কমিটির সদস্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মানসিক রোগীর সঙ্গে বলপ্রয়োগ, তাঁর গায়ে হাত তোলা বা কোনোভাবেই মারধর করা যাবে না। রোগীকে মৌখিকভাবে শান্ত করতে হবে। তাতে কাজ না হলে কৌশলে একটি কক্ষে আটকে রাখতে হবে।

হেলালউদ্দিন বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে যাতে বেসরকারি মানসিক হাসপাতাল না থাকে, তদন্ত প্রতিবেদনে সেই সুপারিশ করা হবে।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেশির ভাগই লাইসেন্সের শর্ত মানছে না। যেমন মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডের বি ব্লকে অবস্থিত ঠিকানা সাইক্রিয়াটিক অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডিকশন এক অনুমোদিত মানসিক হাসপাতাল। ২০ শয্যার এই হাসপাতালে ৬ জন চিকিৎসক, ১২ জন নার্স ও ৬ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকার কথা। কিন্তু এই সংখ্যক জনবল সেখানে নেই।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৮-১৯ অনুযায়ী, দেশের দুই কোটির বেশি মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, লাইসেন্সের শর্তানুযায়ী ১০ শয্যার মানসিক হাসপাতাল চালাতে সার্বক্ষণিক তিনজন চিকিৎসক, ছয়জন নার্স ও তিনজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাখা বাধ্যতামূলক। শয্যা যত বেশি, আনুপাতিক হারে এই সংখ্যা বাড়বে।

কিন্তু প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেশির ভাগই লাইসেন্সের শর্ত মানছে না। যেমন মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডের বি ব্লকে অবস্থিত ঠিকানা সাইক্রিয়াটিক অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডিকশন এক অনুমোদিত মানসিক হাসপাতাল। ২০ শয্যার এই হাসপাতালে ৬ জন চিকিৎসক, ১২ জন নার্স ও ৬ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকার কথা। কিন্তু এই সংখ্যক জনবল সেখানে নেই।

গতকাল শনিবার দুপুরে ওই হাসপাতালের ব্যবস্থাপক শাহিনা আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৩ বছর আগে ২০ শয্যার এই হাসপাতাল চালু হয়। এখানে ২৪ ঘণ্টায় পালা করে চারজন চিকিৎসক থাকেন। চারজন করে নার্স ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী দায়িত্ব পালন করেন। শাহিনা আক্তার জানান, তাঁদের এখানে সবচেয়ে বেশি রোগী আসে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে।

একই এলাকায় নবাব সিরাজউদ্দৌলা মেন্টাল হসপিটাল। এর মালিক আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালটি ৪০ শয্যার। এর মধ্যে ২০ শয্যা মানসিক ও ২০ শয্যা মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। একেক কক্ষে তিনজন করে মানসিক রোগী রাখা হয়। এই হাসপাতালে কেবল একজন মেডিকেল অফিসার ও ছয়জন নার্স আছেন।

অথচ লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী এই হাসপাতালে সার্বক্ষণিক ১২ জন চিকিৎসক, ২৪ জন নার্স ও ১২ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকার কথা। আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘যেসব ডাক্তার আমাদের কাছে রোগী রেফার করেন, তাঁরাই এসে রোগী দেখে যান।’

প্রতি মাসে বেসরকারি মানসিক হাসপাতালগুলোতে অভিযান পরিচালনা করার কথা থাকলেও লোকবলের অভাবে অধিদপ্তর তা পারছে না। এই সুযোগের অপব্যবহার করছে তারা।
ফরিদ উদ্দিন মিঞা , স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক)

র‌্যাব সূত্র জানায়, লাইসেন্স ও চিকিৎসক না থাকার দায়ে ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল এই হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়েছিলেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরের বছরের সেপ্টেম্বরে লাইসেন্স নিয়ে হাসপাতালটি আবার চালু করা হয়।

বেসরকারি মানসিক হাসপাতালগুলোর লাইসেন্সের শর্ত লঙ্ঘন সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ফরিদ উদ্দিন মিঞা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি মাসে বেসরকারি মানসিক হাসপাতালগুলোতে অভিযান পরিচালনা করার কথা থাকলেও লোকবলের অভাবে অধিদপ্তর তা পারছে না। এই সুযোগের অপব্যবহার করছে তারা।

মাইন্ড অ্যান্ড সাইকিয়াট্রিক অ্যান্ড ডি-অ্যাডিকশন হসপিটাল মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের লাইসেন্স নিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা দিয়ে আসছিল

হুমায়ুন রোডের ‘মন নিরাময়’ নামের হাসপাতালটি অনুমোদন নিয়েছিল মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র হিসেবে। কিন্তু সেখানেও মানসিক রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। গত শুক্রবার বিকেলে সরেজমিনে ওই হাসপাতালে গেলে সহকারী ব্যবস্থাপক নুরুল আবছার এই কথা জানান। তিনি বলেন, ২০ শয্যার এই হাসপাতালে চারজন চিকিৎসক ও তিনজন নার্স আছেন। হাসপাতালের মালিক নিজেও একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তিনি রোগীকে চিকিৎসা দেন। এ ছাড়া প্রয়োজনে চিকিৎসক ডেকে আনা হয়।

বেসরকারি হাসপাতালের অনিয়ম ও অপচিকিৎসার বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। র‌্যাব সদর দপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে বদলি) মো. সারওয়ার আলম গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ঢাকায় ১০টি বেসরকারি মানসিক হাসপাতালে অভিযানে চালিয়ে নানা অনিয়ম পান। তাঁদের বিভিন্ন অঙ্কের জরিমানা করা হয়। এর মধ্যে লাইসেন্স ও চিকিৎসক না থাকা এবং রোগীকে মারধর করার দায়ে মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডের নবাব সিরাজউদ্দৌলা হাসপাতাল, বাবর রোডের ইসলামিয়া মেন্টাল হসপিটাল, গুলশানের মুক্তি মেন্টাল ক্লিনিক ও দক্ষিণখানে আরেকটি মানসিক হাসপাতাল সিলগালা করে দেওয়া হয়েছিল। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, অভিযানের সময় দেখা গেছে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের লাইসেন্স নিয়ে মানসিক হাসপাতাল চালাচ্ছে। মাদকাসক্ত ও মানসিক রোগীদের মেঝেতে রাখা হয়েছে। রোগীর চিকিৎসার জন্য নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ থাকা আবশ্যক। ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযানকালে কোনো হাসপাতালে এমন বিশেষজ্ঞ পাননি।

মানসিক চিকিৎসার এই দুর্দশার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে বেসরকারি মানসিক হাসপাতালগুলোর বৈঠক করে শর্ত পূরণে সময় বেঁধে দিতে হবে। তারপরও শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে লাইসেন্স বাতিলসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।