প্রেম ও বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সাত দিন ধরে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এরপর বন্ধুর কাছে থাকা সুইচ গিয়ার চাকু ধার নিয়ে কলেজছাত্রী শারমিন আক্তারকে (১৮) ভয় দেখাতে যান মোস্তাকিম। কিন্তু ভয় দেখাতে পথ আটকাতেই তাঁকে চড় মারেন শারমিন। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ছুরিকাঘাত করে শারমিনকে হত্যা করা হয়।
গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে শারমিন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার কলেজছাত্র মোস্তাকিম রহমান ওরফে রাজু (১৯) আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এই তথ্য দিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে গাজীপুরের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল আদালতের বিচারক মো. হামিদুল ইসলাম এই জবানবন্দি গ্রহণ করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোনাবাড়ী মেট্রোপলিটন থানার পরিদর্শক কালিন্দনাথ গোলদার প্রথম আলোকে বলেন, কোনাবাড়ী আমবাগ পশ্চিমপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোস্তাকিম রহমানকে গ্রেপ্তারের পর গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠানো হয়। আদালতে বিচারকের সামনে হত্যার কথা স্বীকার করায় রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করা হয়। জবানবন্দি গ্রহণ শেষে তাঁকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।
কালিন্দনাথ গোলদার বলেন, মোস্তাকিম আদালতের বিচারককে জানান, কলেজছাত্রী শারমিন আক্তারকে অনেক দিন ধরেই তিনি ভালোবাসেন। এরই মধ্যে তাঁদের দুজনের আলাপ–আলোচনাও হয়েছে। পরবর্তীকালে প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে শারমিন তাঁকে বিরক্ত না করার জন্য অনুরোধ করেন। তারপরও মোস্তাকিম বিভিন্ন সময়ে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে শারমিনকে বিয়েরও প্রস্তাব দেওয়া হয়। সেই প্রস্তাবেও রাজি না হওয়ায় তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়, যাতে ভয়ে তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হন। এরপর পাঁচ–ছয় দিন কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেন শারমিন। এরপর যখন কলেজে আসা শুরু করেন, আবারও তাঁকে প্রস্তাব দিলে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁকে বারবার ফিরিয়ে দেওয়ার তাঁর এক বন্ধুর কাছ থেকে একটি সুইচ গিয়ার চাকু ধার করেন ভয় দেখানোর জন্য। গত বুধবার তিনি কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে কোনাবাড়ী কাঁচাবাজার এলাকায় গতিরোধ করলে শারমিন ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে (মোস্তাকিম) একটি থাপ্পড় মারেন। এ সময় মোস্তাকিম নিজের পকেট থেকে চাকু বের করে তাঁর গলার নিচে আঘাত করে পালিয়ে যান।
গতকাল শুক্রবার সকালে কোনাবাড়ী আমবাগ এলাকায় শারমিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, এখনো মাতম চলছে। শারমিনের ঘরের সামনে বসে কান্না করছেন মা তাসলিমা বেগম। আশপাশের প্রতিবেশীরা নানা কথা বলে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। মা তাসলিমা বেগম বলেন, ‘এক মাসও হয়নি মেয়েটিকে বিরক্ত করায় ওই ছেলের মায়ের কাছে বিচার দিয়েছিলাম। তখন তাঁরা এর জন্য ক্ষমাও চেয়েছিলেন। যার কারণে আমরা আর পুলিশের কাছে যাইনি। তাঁরা কথাও দিয়েছিলেন, আমার মেয়েকে আর বিরক্ত করা হবে না। তখন আইনের আশ্রয় নিলে আজ হয়তো মেয়েটারে হারাতে হতো না।’
শারমিনের পিতা গাড়িচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাজারের ব্যবসায়ীরাও দেখেছেন, আর ওই আসামিও আদালতে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। এখন হত্যাকারীর ফাঁসি চাই।’
কোনাবাড়ী আমবাগ পশ্চিমপাড়া এলাকায় জালাল উদ্দিনের বাড়িতে ভাড়া থাকে মোস্তাকিমের পরিবার। তাঁর পিতা আগে নিরাপত্তাপ্রহরীর চাকরি করতেন, আর মা একটি ঝুটের গোডাউনে কাজ করেন। ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। বাড়ির মালিক জালাল উদ্দিন জানান, কাউকে কিছু না বলেই ঘরে তালা দিয়ে তারা পালিয়েছে। এর আগেও মোস্তাকিমের বিরুদ্ধে মেয়েঘটিত বিষয়ে অভিযোগ এসেছে। ছেলেটি কলেজে পড়লেও নিয়মিত কলেজে যেতেন না। বখাটে ছেলেদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতেন। এর আগেও অন্য একটি মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার বিষয়ে বাড়িতে সালিস হয়েছিল। তখনো ক্ষমা চেয়ে রক্ষা পান তাঁরা।
গাজীপুর মহানগরের কোনাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমদাদুল হক জানান, গ্রেপ্তার মোস্তাকিম আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। মোস্তাকিমের ছুরির আঘাতে শারমিনের শ্বাসনালি কেটে যায়। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়। ওই মামলার নামীয় আসামি মো. শামিম (২০), মো হায়দার (২০), মো. জুয়েল (১৯) ও মো. রোমানকে (২০) গ্রেপ্তার করতে অভিযান চলছে।
প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় গত বুধবার গাজীপুর নগরের কোনাবাড়ী কাঁচাবাজার এলাকায় প্রকাশ্যে কলেজছাত্রী শারমিনকে ছুরিকাঘাত করেন মোস্তাকিম। এ সময় পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় মানুষ ধাওয়া করে মোস্তাকিমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশে দেন।