বাইরের ফটকে রোল নম্বর টাঙানো থাকলেও পরীক্ষার হলে আসনবিন্যাস ঠিকমতো ছিল না। যে যাঁর মতো বসেছেন। দুজনের ছোট বেঞ্চে বসতে হয়েছে চার থেকে ছয়জনকে। পরীক্ষা শুরুর নির্ধারিত সময়ের আধা ঘণ্টা পরও অনেক কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র যায়নি। অনেক কেন্দ্রে ছাপা প্রশ্নপত্র এতটাই অস্পষ্ট ছিল যে তা পড়তে রীতিমতো গলদঘর্ম হতে হয়েছে পরীক্ষার্থীদের।
গতকাল শুক্রবার রাষ্ট্রমালিকানাধীন তিন ব্যাংকসহ আট ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে এ রকম অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রশ্নপত্র ও বসার জায়গা না পেয়ে শাহ আলী মহিলা কলেজ কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীরা ভাঙচুর ও সড়ক অবরোধও করেছেন। ওই কেন্দ্রের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ২০ জানুয়ারি। গতকাল সারা দেশে মোট ৬১টি কেন্দ্রে পরীক্ষা হয়েছে।
গত বছর সোনালী, রূপালী ও জনতা ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে নিয়োগ পরীক্ষাসহ পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা না করতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন। গত বৃহস্পতিবার চেম্বার বিচারপতি সে আদেশ স্থগিত করেন। এই আদেশের ফলে ওই তিন ব্যাংকসহ আট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার (সাধারণ) ১ হাজার ৬৬৩টি শূন্য পদে ২ লাখ ১৩ হাজার ৫২৫ জন পরীক্ষার্থী আবেদন করেছিলেন।
তবে পরীক্ষার সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মহিউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষা সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়েছে এবং তা স্থগিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অব্যবস্থাপনা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরীক্ষার আগে আমরা যখন কেন্দ্র বুকিং দিই, তখন জানতে চাই পাঁচ থেকে ছয় ফুট লম্বা মাপের কতগুলো বেঞ্চ আছে। তারা একটা ধারণা দেয়। সেই কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করে গজ-ফিতা নিয়ে বেঞ্চ মেপে দেখার সুযোগ থাকে না। কিন্তু পরীক্ষার কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় বেঞ্চের মাপ তিন থেকে চার ফুট। ফলে ছেলেমেয়েদের বসতে সমস্যা হয়েছে। তবে সব মিলিয়ে শাহ আলী মহিলা কলেজ কেন্দ্র ছাড়া সব জায়গাতেই পরীক্ষা সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়েছে। ৬০ শতাংশ পরীক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।’
অধ্যাপক মহিউদ্দীন আরও বলেন, ২০ জানুয়ারি শাহ আলী মহিলা কলেজ কেন্দ্রের ৫ হাজার ৬০০ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা ওই কলেজ এবং সরকারি বাঙলা কলেজ কেন্দ্রে নেওয়া হবে। এর মধ্যে ১ হাজার ৬০০ জন শাহ আলী কলেজে আর বাঙলা কলেজের ৪ হাজার পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়া হবে।
আর পরীক্ষার কেন্দ্রে মুঠোফোন নিষিদ্ধ থাকলেও অধিকাংশ কেন্দ্রেই পরীক্ষার্থীরা তা নিয়ে ঢুকেছেন। পরীক্ষা শুরুর কিছুক্ষণ পর থেকে ফেসবুকে চাকরিপ্রার্থীদের বিভিন্ন গ্রুপে পরীক্ষার অব্যবস্থাপনা নিয়ে ছবি আর ভিডিও আসা শুরু করে।
গতকাল বিকেলে শাহ আলী কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক বাইরে হইচই করছেন। চট্টগ্রাম থেকে মেয়েকে নিয়ে ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার জন্য এসেছেন মোশাররফ হোসেন। তাঁর মেয়ে বললেন, তিনি বসারই জায়গা পাননি। হলে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরীক্ষা শুরুর সময় গড়িয়ে গেলে জানানো হয়, প্রশ্নপত্রও কম, সবাইকে দেওয়া যাচ্ছে না। কেন্দ্রে হইচই শুরু হয়ে যায়। আধঘণ্টা পর কেন্দ্রের পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
শাহ আলী মহিলা কলেজ কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী রাসেল জানান, হলে ঢোকার সময় দেখেন বাইরে রোল নম্বর টাঙানো আছে। কিন্তু কক্ষের ভেতর কোনো আসন পরিকল্পনা নেই। যত পরীক্ষার্থী, তার চেয়ে আসনসংখ্যা অনেক কম। পরে কেন্দ্র থেকে বলা হয় যে যেখানে পারেন, বসে যান। সবাই বসার পরও দুই থেকে আড়াই শ পরীক্ষার্থীর আর বসার জায়গা হচ্ছিল না। বেলা সাড়ে তিনটায় পরীক্ষা শুরুর পরই দেখা যায় অনেকেই প্রশ্ন পাননি। এরপরে পরীক্ষার্থীরা হইচই শুরু করেন। কেউ কেউ কেন্দ্রে ভাঙচুর শুরু করেন।
বিকেল ৪টা ৫ মিনিটের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি এসে বলেন, ‘কেন্দ্রের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। আপনারা সবাই একে একে কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যান।’ এ ঘোষণায় পরীক্ষার্থীরা আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তাঁরা হইচই ও ভাঙচুর শুরু করেন। একদল পরীক্ষার্থী রাস্তা (মাজার রোড) অবরোধ করে বসে পড়েন। একটু পর সাংসদ আসলামুল হক কিছু নেতা-কর্মীসহ কলেজে আসেন। তিনি পরীক্ষার্থীদের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলতে চান। পরীক্ষার্থীদের পাঁচজন প্রতিনিধি সাংসদের সঙ্গে কথা বলে পরীক্ষার নতুন তারিখ নির্ধারিত হওয়ার পর তাঁরা রাস্তা ছাড়েন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্যসচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন খান শুধু একটি কেন্দ্রে সমস্যার কথা বলেন। তিনি বলেন, মিরপুরের শাহ আলী মহিলা কলেজ কেন্দ্রে পাঁচ হাজারের বেশি পরীক্ষার্থী অংশ নেন। কিন্তু আসন ব্যবস্থাপনায় কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। এই কেন্দ্রের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা কেবল শাহ আলী কলেজে অব্যবস্থাপনার কথা বললেও ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে কমবেশি নানা অব্যবস্থাপনা হয়েছে বলে অভিযোগ পরীক্ষার্থীদের। প্রার্থীদের এক ঘণ্টাব্যাপী ১০০ নম্বরের একটি এমসিকিউ পরীক্ষা নেওয়ার কথা ছিল। তবে পরীক্ষার সময় পার হয়ে গেলেও অনেক প্রার্থী প্রশ্ন পাননি।
মিরপুরের গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটে পরীক্ষা দেওয়া নাজমুল হাসান বলেন, সেখানে প্রশ্ন আসে আধা ঘণ্টা দেরিতে। দেরি হওয়ায় তিনি সব প্রশ্নের উত্তরে বৃত্ত ভরাট করতে পারেননি।
আবার দনিয়া এ কে স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষার নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট পর প্রশ্নপত্র এসে পৌঁছায়। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুটি ভবন। পুরোনো ভবন থেকে নতুন ভবনের দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। ওই কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে শুধু কেন্দ্রের নাম ও রুম নম্বর উল্লেখ ছিল। কিন্তু পরীক্ষার আসন কার কোন ভবনে পড়েছে, তা ছিল না। আরিফুর রহমান নামের এক পরীক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, কার সিট কোথায় পড়েছে, তার উল্লেখ নেই। যে যাঁর মতো বসে পরীক্ষা দিয়েছেন।