ঢাকার শ্যামপুরের ব্যবসায়ী ইউনূস হাওলাদার খুনের ‘পরিকল্পনাকারী’ হিসেবে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি হলেন শ্যামপুর থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) নূর আলম। ব্যবসায়ী ইউনূসকে মামলা থেকে বাদ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ডেকে নিয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে হত্যা করা হয়। তাঁর কাছে থাকা তিন লাখ টাকা নিয়ে নূর আলমের কাছে দেওয়া হয়।
গুরুতর এমন অভিযোগে গতকাল শনিবার রাতে নূর আলমকে গ্রেপ্তার করেছে কেরানীগঞ্জ থানার পুলিশ। এর আগে পুলিশ কর্মকর্তা নূর আলমকে থানা থেকে প্রত্যাহার (ক্লোজড) করে নেওয়া হয়। ব্যবসায়ী ইউনূস হত্যায় গ্রেপ্তার আসামির ১৬৪ ধারার জবানবন্দি এবং তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলছেন, ইউনূস হাওলাদার খুনের পরিকল্পনাকারী হলেন এএসআই নূর আলম। গতকাল রাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। আজ রোববার নূর আলমকে আদালতে পাঠানো হবে। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ জামান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ী ইউনূস হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার এএসআই নূর আলমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।
শ্যামপুর থানার ওসি মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেছেন, ব্যবসায়ী ইউনূস হাওলাদার হত্যায় আসামির জবানবন্দিতে এএসআই নূর আলমের নাম আসার পরপরই তাঁকে থানা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অবশ্য অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা নূর আলম গতকাল শনিবার দুপুরে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। হত্যাকাণ্ডে তিনি কোনোভাবে জড়িত নন।
গত ২৫ জুন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার হাসনাবাদ এলাকা থেকে অজ্ঞাত এক বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর সেদিন রাতে নিহত ব্যক্তির ছেলে আতিকুজ্জামান বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ মামলায় নিহত ইউনূস হাওলাদারের বাড়ির ভাড়াটে ওহিদ সুমন (২৭) এবং যাত্রাবাড়ী এলাকার ছাবের ওরফে শামীমকে (৪৩) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে খুনের দায় স্বীকার করে ঢাকার আদালতে জবানবন্দি দেন সুমন। সেখানেই তিনি বলেন, এ খুনের পরিকল্পনাকারী এএসআই নূর আলম। পুরান ঢাকার নবাবপুরে কৃষি যন্ত্রাংশের ব্যবসা করতেন ইউনূস হাওলাদার। বছর দশেক আগে ব্যবসা থেকে অবসর নেন তিনি।
মানব পাচারের মামলা
ইউনূস হাওলাদারের তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। ঢাকার শ্যামপুরে তাঁর দুটি বাড়ি আছে। একটিতে তিনি পরিবার নিয়ে থাকতেন। অন্যটি ভাড়া দেওয়া। সেখান থেকে ভাড়াও তুলতেন নিজে। আট মাস আগে গত ১৯ জানুয়ারির তাঁর বাসায় অভিযান চালিয়ে পাঁচ ভাড়াটেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ইউনূস হাওলাদারের নামে মানব পাচার আইনে মামলা হয়। অভিযোগ আনা হয় বাসায় পতিতাবৃত্তি করানোর।
আগে কোনো মামলায় না পড়া ব্যবসায়ী ইউনূস হাওলাদার উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন।
ইউনূস হাওলাদারের স্ত্রী মারুফা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ তাঁর স্বামীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। মামলা করার পর থেকে তাঁর স্বামী উদ্ভ্রান্তের মতো এখানে-সেখানে ছোটাছুটি করা শুরু করেন। মারুফা জানান, মামলার আগে গত বছর তাঁর স্বামী ইউনূস সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন।
ইউনূস হাওলাদারের বাসায় ভাড়া থাকেন ওহিদ সুমন। তিনি কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া বিআরটিএ অফিসের দালাল। মামলার ব্যাপারে সুমনের সাহায্য চান ইউনূস হাওলাদার। তাঁর পাশের বাসায় ভাড়া থাকতেন এএসআই নূর আলম।
ইউনূসের বাসার দারোয়ান হেমায়েত প্রথম আলোকে জানান, পুলিশ কর্মকর্তা নূর আলমকে দালাল সুমনের বাসায় কয়েকবার আসা-যাওয়া করতে দেখেছেন।
ওহিদ সুমন আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, ইউনূস হাওলাদার তাঁকে পুলিশ কর্মকর্তার নূর আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। নূর আলমকে এ ঘটনা জানানোর পর তিন লাখ টাকা চান তিনি। ইউনূসও তিন লাখ টাকা দিতে রাজি হন।
সুমন আদালতে আরও বলেন, ‘নূর আলম ভাইকে জিজ্ঞাসা করি, কবে কখন স্যারের কাছে নিয়ে যাবেন। তখন জুন মাসের ২৩ তারিখ গেন্ডারিয়ায় আমাকে আসতে বলেন। সেখানে যাওয়ার পর একটা লোক মোটরসাইকেলে করে আসেন, তাঁর নাম শামীম। তিনি বলেন, সে আমার লোক।’
মামলা থেকে বাঁচতে চেয়েছিলেন
মামলার আসামি হওয়ার পর ইউনূস হাওলাদারের ছোটাছুটি দেখে তাঁর স্ত্রী মারুফা তাঁকে বারবারই বলেছিলেন, এই মিথ্যা মামলায় তাঁর কিছুই হবে না। আদালত থেকে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। তবে নিহত ইউনূস স্ত্রীকে বলেছিলেন, মিথ্যা মামলা থেকে তিনি বাঁচতে চান।
ইউনূস তাঁর স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন, মামলা থেকে বাঁচার জন্য তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পুলিশের সঙ্গে কথাও বলছেন। মামলা থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য তারা ৫০ হাজার টাকা চায়। মারুফা বললেন, কাউকে টাকা দিতে তিনি বারণ করেছিলেন। সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, টাকার জন্য তিনি বিপদে পড়তে পারেন।
টাকাই যখন কাল হলো
ওহিদ সুমন আদালতকে জানান, পুলিশ কর্মকর্তা নূর আলম শামীমের (গ্রেপ্তার আসামি) সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন। ২৪ জুন ইউনূসকে নিয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া এলাকার বিআরটিএ অফিসে থাকতে বলেন। সঙ্গে নিয়ে আসতে বলেন তিন লাখ টাকা।
সুমন জবানবন্দিতে বলেন, ‘নূর আলম দারোগার ডিউটি আছে, তাই সে থাকবে না। তার লোক শামীম থাকবে। পরে আমি ইউনূস সাহেবের বাসায় গিয়ে জানাই কোথায়, কীভাবে সাক্ষাৎ করতে হবে। বলি, রাত ১০টার দিকে স্যারের বাসায় নিয়ে যাবে। ইউনূস সাহেব বলে, ঠিক আছে। রাত ১০টার দিকে যাব। ২৪ জুন ইউনূস চাচাকে সঙ্গে নিয়ে বিআরটিএ অফিসের সামনে আসি। সেখানে শামীমকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আমি তাঁকে ডাক দিই। তিনি আমাকে বলেন, ওই সিএনজিতে ওঠেন। শামীম আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, চাচা টাকা এনেছে কি না? তখন চাচা তার টাকার ব্যাগে হাত দিয়ে বলে, টাকা আছে। সিএনজিতে উঠে আরেকজনকে দেখি। আমি শামীমকে জিজ্ঞাসা করি, উনি কে? তখন শামীম বলে, আমার লোক। গাড়িটি বিআরটিএ অফিস থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় যায়। অটোরিকশা থেকে নেমে হাঁটতে থাকি। হঠাৎ শামীম চাচাকে (ইউনূস) ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। ছুরি দিয়ে কোপাতে থাকে। পরে চাচার কাছে থাকা টাকার ব্যাগ নেয় শামীম। আমরা তিনজনে মিলে আবার অটোরিকশায় করে শ্যামপুর থানার কাছে আসি। সেখানে দারোগা নূর আলম উপস্থিত ছিলেন। গাড়ি থেকে নামার পর শামীম ওই টাকার ব্যাগ দারোগা নূর আলমের হাতে দিল। নূর আলম তাঁর মানিব্যাগ থেকে দুই হাজার টাকা বের করে দিয়ে বলে, এই মুহূর্তে তুমি বাড়ি চলে যাও।’
অবশ্য মানব পাচার আইনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শ্যামপুর থানার এসআই নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, খুন হওয়ার আগে মে মাসে ইউনূস হাওলাদারসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। মামলা থেকে ইউনূস হাওলাদারের নাম বাদ দেওয়ার ব্যাপারে এএসআই নূর আলম কিংবা আসামি ইউনূস হাওলাদার কখনো তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।
ইউনূসের কথোপকথন
মামলায় নিহত ইউনূস হাওলাদারের ছেলে আতিকুজ্জামান জানান, ২৪ জুন সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হয়ে যান ইউনূস। রাত আটটার দিকে তাঁর ভাই লিংকনের সঙ্গে কথা বলেন। কোথায় আছেন জানতে চাইলে তাঁর বাবা জানান, তিনি আছেন মালিবাগে। মামলায় আতিকুজ্জামান বলেন, রাত ১০টার দিকে তাঁর বাবা বাসায় ফেরেন। তিনি তাঁর পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ তিন লাখ টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হন। রাত সাড়ে ১১টায় ফোন দিলে ইউনূস হাওলাদার জানান, পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে তিনি বাসায় ফিরবেন। তবে রাত ১২টার দিকে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যায়।
ইউনূসের স্ত্রী মারুফা জানান, মোবাইল বন্ধ পাওয়ার পর তিনি নানা জায়গায় ফোন দেওয়া শুরু করেন। ফোন দেন ভাড়াটে সুমনকেও। সুমন তখন তাঁকে জানান, তাঁর মামাশ্বশুর গুরুতর অসুস্থ। তিনি আছেন শনির আখড়ায়। অথচ সুমনের মোবাইল ফোনের কল ডিটেইলস রেকর্ড (সিডিআর) বলছে, ২৪ জুন রাত ১২টার পর তাঁর অবস্থান ছিল দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ এলাকায়। নূর আলমের সঙ্গে সেদিন সুমনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কথোপকথন হয়।
পুলিশ অভিযান চালিয়ে সুমনকে বাগেরহাট থেকে ১১ জুলাই গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে। ১২ জুলাই সুমন ইউনূস হাওলাদারকে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। তাঁর জবানবন্দিতে নাম আসা ছাবেরকে পরদিন পুলিশ গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায়।
আদালতকে লিখিতভাবে পুলিশ জানায়, ইউনূস হাওলাদারকে হত্যা করে তাঁর কাছে থাকা তিন লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় আসামিরা। শামীম ছুরি দিয়ে ইউনূসকে হত্যা করেন।
নূর আলমের যুক্তি
পুলিশ কর্মকর্তা নূর আলম প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন, নিহত ইউনূস হাওলাদারের ভাড়াটে সুমন তাঁর পূর্বপরিচিত। ইউনূসের বাড়ির পাশেই তিনি ভাড়া থাকতেন। তবে সুমন আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সুমন তাঁর সোর্স ছিলেন। শামীমকে তিনি চেনেন না। কোনো দিনও দেখেননি। তবে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সোর্স হলেন আসামি শামীম। নূর আলম তাঁকে আগে থেকে চেনেন।
তবে তদন্ত কর্মকর্তা কেরানীগঞ্জ থানার এসআই গোলাম মোস্তফা গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, ব্যবসায়ী ইউনূস খুনে নূর আলম জড়িত আছেন।
তবে নিহত ব্যক্তির ছেলে আতিকুজ্জামান, স্ত্রী মারুফা বেগম বলছেন, হত্যাকাণ্ডে পুলিশ জড়িত থাকায় বিচার পাওয়া নিয়ে তাঁদের মধ্যে সংশয় আছে।
তবে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেছেন, এ খুনের সঙ্গে জড়িত কেউ রেহাই পাবেন না, সে যে-ই হোক। অপরাধী যে-ই হোক তাঁকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।