বিচারবহির্ভূত হত্যার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পেয়ে তা নিজ স্বার্থে ব্যবহারের অন্যতম বড় উদাহরণ আর্জেন্টিনার আর্কিমিডিস রাফায়েল পুচ্চিও। শুরুতেই তাঁর গল্পটি জানা যাক। তিনি তিনটি সরকারি সংস্থার সক্রিয় সদস্য ছিলেন। যেমন সেক্রেটারিয়েট অব ইন্টেলিজেন্স (সাইড), দা আর্জেন্টিনা অ্যান্টি কমিউনিস্ট অ্যালায়েন্স (ট্রিপল-এ) এবং দা ব্যাটালিয়ন ডি ইন্টেলিজেনশিয়া ৬০১। এর মধ্যে সাইড দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। ট্রিপল-এ দক্ষিণপন্থীদের একটি ডেথ স্কোয়াড গ্রুপ, যাদের কাজ ছিল বামপন্থীসহ সরকারবিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করা। আর দা ব্যাটালিয়ন ডি ইন্টেলিজেনশিয়া ৬০১ আর্জেন্টিনার আর্মিদের একটি গোপন সংস্থা। সরকারবিরোধী বিভিন্ন গেরিলা গ্রুপ ও মানবাধিকার সংগঠনের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে তথ্য সংগ্রহ করা, অপহরণ ও গুম-হত্যা করাই ছিল তাদের মূল কাজ। মূলত ‘ডার্টি ওয়ার’–এর সময় সংস্থাটি বেশি সক্রিয় ছিল।
আর্জেন্টিনায় বরাবরই ছিল সামরিক শাসনের প্রাধান্য। ৫০ ও ৬০–এর দশকের কিছু সময় বেসামরিক সরকার থাকলেও ঘুরেফিরে বারবারই সামরিক শাসকেরা দেশটির ক্ষমতা দখল করেছে। সামরিক শাসকদের মধ্যে কর্নেল জুয়ান পেরন ১৯৫৫ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে নির্বাসিত থাকার পরে ১৯৭৩ সালে আবার দেশে ফিরে আসেন এবং প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। এক বছর পরেই মারা গেলে তাঁর তৃতীয় স্ত্রী ইসাবেল মার্টিনেজ পেরন নতুন প্রেসিডেন্ট হন। তাঁর সময়টি ভালো যায়নি। এই সুযোগে ১৯৭৬ সালের ২৪ মার্চ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জর্জ রাফায়েল ভাইদেলারের নেতৃত্বে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করে।
ক্ষমতা দখল করেই সামরিক সরকার ন্যাশনাল রি-অর্গানাইজেশন প্রসেস বা জাতীয় পুনর্গঠন প্রক্রিয়া নামে একটা কর্মসূচি শুরু করে। এটি ছিল মূলত বামপন্থী গেরিলাসহ সরকারবিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার একটি কর্মসূচি। সন্দেহ হলেই যখন-তখন তুলে নেওয়া, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন বা গুম করা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এই ঘটনাকে বলা হয় ডার্টি ওয়ার বা নোংরা যুদ্ধ। ফকল্যান্ড যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পরে ১৯৮২ সালে সামরিক সরকারের পতন ঘটলে বের হয় নোংরা যুদ্ধের নানা তথ্য। নোংরা যুদ্ধের সময় প্রায় ৩০ হাজার আর্জেন্টিনাবাসী নির্যাতন, গুম বা নিহত হয়েছিলেন।
ডার্টি ওয়ার-এর সঙ্গে ‘অপারেশন কনডর’-এর একটা সম্পর্ক আছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে মার্ক্সবাদের বিস্তার রোধে পরিচালিত একটি অভিযানের নাম অপারেশন কনডর। ১৯৭৫ সালে আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, চিলি, প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়ের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের বৈঠকের মাধ্যমে এই অভিযানের পরিকল্পনা শুরু হয়। পরে ব্রাজিল, ইকুয়েডর ও পেরু এতে যোগ দেয়। ১৯৮৩ পর্যন্ত গোপনে চলা এই অভিযানে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর ৬০ হাজার থেকে ৮০ হাজার মানুষ গুম-খুনের শিকার হন, জেলে ছিলেন আরও ৪ লাখ মানুষ। পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়, অপারেশন কনডর পুরোটাই মার্কিন সমর্থনপুষ্ট। ওই সময়ের আরও অনেক মার্কিন দুষ্কর্মের মতো এ ক্ষেত্রেও অভিযোগের আঙুল সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের দিকে।
আর্কিমিডিস রাফায়েল পুচ্চিও ৭০ ও ৮০–এর দশকের এই অপহরণ, গুম-খুনের কাজে এক সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৮৩ সালে আর্জেন্টিনায় সরকার বদল হলে আগে যা সরকারের হয়ে করতেন, তা তিনি নিজের জন্য করা শুরু করেন আর্কিমিডিস পুচ্চিও। পেশা হিসেবে অপহরণ ও গুম-খুন চালিয়ে যেতে থাকেন। এই কাজে পুরো পুচ্চিও পরিবারই জড়িত ছিল। দলে আরও যুক্ত হন তাঁর অতীত অপকর্মের আরও দুই সঙ্গী, যাঁদের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল রডল্ফ ভিক্টোরিয়ানো ফ্রাঙ্কো। পুচ্চিও পরিবারের বড় পুত্র আলেজান্দ্রো পুচ্চিও তখন আর্জেন্টিনার জনপ্রিয় রাগবি খেলোয়াড়, জাতীয় দলে খেলেন। বাবার এই নতুন ব্যবসার প্রধানতম সঙ্গী আলেজান্দ্রো। আরেক ছেলে ড্যানিয়েলও তাই। তাঁদের লক্ষ্য ছিল ধনীরা। অপহরণ করে মুক্তিপণ না পাওয়া পর্যন্ত নিজের বাসাতেই এক রুমে আটকে রাখতেন আর্কিমিডিস পুচ্চিও।
১৯৮২ সালের ২২ জুলাই পুচ্চিও পরিবার প্রথম অপহরণ করে ২৩ বছরের রিকার্ডো মনুকিয়ানকে। রিকার্ডো ছিলেন আলেজান্দ্রোর বন্ধু, ফলে ফাঁদে ফেলে অপহরণ করতে সহজ হয়। আড়াই লাখ ডলার মুক্তিপণ পেয়েও রিকার্ডোকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলেন তাঁরা। এভাবে আরও তিনজনকে অপহরণ করা হয়। তবে চতুর্থবার অপহরণ ঘটনায় অনেক কিছু উল্টাপাল্টা হয়ে যায়। এক মাস আটকে রাখতে হয়। পরিবারের সদস্যরা মুক্তিপণ দিতে টালবাহানা করেন। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। ১৯৮৫ সালের ২৩ আগস্ট পুচ্চিওদের বাড়ি ঘেরাও করে পুলিশ। অপহরণ হওয়া নেলিদা পেড্রোকে উদ্ধার করা হয়। পুরো ঘটনা আর্জেন্টিনাবাসীকে চমকে দেয়।
পুচ্চিও পরিবারের কথা নতুন করে সামনে আসে ২০১৫ সালে। ওই বছর মুক্তি পায় দা ক্লান নামের এক সিনেমা। তুমুল জনপ্রিয় হয়, অস্কারে পাঠায় আর্জেন্টিনা। সরকারের হয়ে বিচারবহির্ভূত কাজের প্রভাব ও পরিণতি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। জানা যায়, সরকারি নীতি হিসেবে অপহরণ, গুম ও খুন হলেও যাঁরা বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের অনেকেই ব্যক্তিস্বার্থেও এসব কাজ করেছেন। নোংরা যুদ্ধের সময় অসংখ্য গর্ভবতী মেয়েকে গুম করা হয়েছিল, যাদের সন্তানদের অবৈধভাবে দিয়ে দেওয়া হয় ঘনিষ্ঠদের। সামরিক জান্তার পতনের পর সেই সব সন্তানের খোঁজে একটি সংগঠন তৈরি করা হয়। গ্র্যান্ডমাদার্স অব দা প্লাজো দি মায়ো নামের এই সংস্থার কাজই ছিল হারিয়ে যাওয়া শিশুদের খুঁজে বের করা। এ রকমই এক ঘটনা নিয়ে করা সিনেমা দা অফিশিয়াল স্টোরি ১৯৮৫ সালে বিদেশি ভাষার সেরা সিনেমার অস্কার পেয়েছিল। নিখোঁজদের খুঁজে বের করতে এ ধরনের সংগঠন চিলিতেও আছে।
দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের অপহরণ ও গুম-খুনের নির্দেশদাতা ও বাস্তবায়নকারী অনেকের বিচার হয়েছে, শাস্তিও পেয়েছেন। কিন্তু দুনিয়া থেকে তা নির্মূল হয়নি। ‘ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ বা ‘এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং’-এখন এ সময়ের আলোচিত বিষয়। এর ধরন পাল্টেছে, অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পাল্টেছে। যেমন এ সময়ের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ফিলিপাইনের মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
২০১৬ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ফ্রেডারিক দুতার্তে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। সেই থেকে সেখানে হাজার হাজার মানুষকে মারা হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তদন্ত করে বলেছে, প্রতিটি হত্যার জন্য পুলিশ বাহিনীকে অর্থ পুরস্কার দেওয়া হয়। এমনকি হত্যা করতে পুলিশ খুনি ভাড়া করেছে এমন ঘটনাও আছে। আর মাদকবিরোধী এই যুদ্ধে মূলত মারা যাচ্ছে গরিব মাদকসেবী, সরবরাহকারী ও নিরীহরাই। অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ হত্যার পর লাশের কাছে মাদক রেখে এসেছে, অনেকে আত্মসমর্পণ করলেও সরাসরি গুলি করে মারা হয়েছে।
‘লাইসেন্স টু কিল’ বা অবাধে খুনের লাইসেন্স দিলে যা হয়, তা–ও ঘটেছে ফিলিপাইনে। সেখানকার পুলিশ মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে ব্যবসায়ীদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। দক্ষিণ কোরীয় ব্যবসায়ী জি ইক-জো থাকতেন ফিলিপাইনেই। ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর বাসা থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আটকের পরে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, জি ইক-জো অবৈধ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তাঁর স্ত্রী এক বিবৃতিতে জানান, তিনি তাঁর স্বামীকে ছাড়িয়ে আনার জন্য ৫০ লাখ পেসো (এক পেসো ১ দশমিক ৭৩ টাকার সমান) দিয়েছেন, আরও ৩০ লাখ পেসো দেওয়া বাকি ছিল। কিন্তু সন্দেহ হওয়ায় সেই টাকা আর দেননি। মুক্তিপণ আদায় করতেই এই অপহরণ।
দক্ষিণ কোরিয়া সরকার এ ঘটনার প্রতিবাদ জানালে ফিলিপাইন তদন্ত করতে বাধ্য হয়। তখন উদ্ঘাটিত হয় প্রকৃত ঘটনা। একাধিক পুলিশ সদস্যকে দায়ী করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়, বিচারকার্য এখনো চলছে। এর দায় নিয়ে পুলিশপ্রধান পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, তবে তা গ্রহণ করা হয়নি। এই ঘটনার জন্য প্রেসিডেন্ট দুতার্তে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চান। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসেবে এখনো এভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যার পক্ষে প্রেসিডেন্ট দুতার্তে। কিন্তু একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং বিদেশি নাগরিককে হত্যার জন্য ঠিকই ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন তিনি।
মাদক বিস্তার রোধে বিচারবহির্ভূত হত্যার ধারণা অবশ্য প্রেসিডেন্ট দুতার্তে ধার করেছিলেন থাইল্যান্ড থেকে। ২০০৩ সালে থাইল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা ইয়াবা বিস্তার ঠেকাতে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। প্রথম তিন মাসেই হত্যা করা হয় ২ হাজার ২৭৫ জনকে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনা হয়। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এখন থাকসিন নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। আর তদন্তে দেখা গেছে, যাঁরা হত্যার শিকার হয়েছেন, তাঁদের অর্ধেকই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।
মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার আরও উদাহরণ হচ্ছে কলম্বিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও অনেক দেশ। আর এই যুদ্ধে এখন শামিল বাংলাদেশও। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও মাদকবিরোধী অভিযানের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ করে আসছে। অবশ্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আগেও ছিল।
১৯৭৫ সালে আটক অবস্থায় মারা যান সিরাজ সিকদার। তাঁর মৃত্যুর পরে তৎকালীন পুলিশ যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছিল, তা ছিল এ রকম, ‘পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি নামে পরিচিত আত্মগোপনকারী চরমপন্থী দলের নেতা সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদারকে পুলিশ গত ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার করে। সেই দিনই তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি দেন এবং তার দলীয় কর্মীদের কিছু গোপন আস্তানা এবং তাদের বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দেখিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশের সঙ্গে যেতেও সম্মত হন। তদনুযায়ী গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে একদল পুলিশ যখন তাকে পুলিশ ভ্যানে করে গোপন আস্তানার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি সাভারের কাছে পুলিশ ভ্যান থেকে লাফিয়ে পড়েন এবং পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। পুলিশ তার পলায়ন রোধের জন্য গুলিবর্ষণ করে। ফলে সিরাজ সিকদারের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়।’
এখন এই গল্পে যুক্ত হচ্ছে আরেকটি লাইন। আর তা হলো, আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বা গ্রেপ্তার অভিযানের সময় পুলিশের ওপর গুলিবর্ষণ এবং আত্মরক্ষায় পুলিশের পাল্টা গুলি বর্ষণ। বাংলাদেশে এর প্রচলিত নাম বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার। বিগত দুই দশকের মধ্যে এই বন্দুকযুদ্ধের কথা প্রথম বড় পরিসরে আলোচনায় আসে ২০০২ সালে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে অভিযান চালানো হয়েছিল। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিডিআর, পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে ৪০ হাজার সদস্য দেশব্যাপী শুরু করেছিলেন সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধার অভিযান। এই অভিযানে মারা যায় ৫৭ জন। পরে ওই অভিযানের কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দিয়ে ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন-২০০৩’ করা হয়। ২০১৭ সালে হাইকোর্ট দায়মুক্তির সেই আইন বাতিল করে দেন। সেই রায়ে বলা হয়, ‘আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা হচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে জঘন্য রূপ। সংবিধান অনুসারে একজন ভয়ংকর অপরাধীরও আদালতের কাছে বিচার চাওয়ার অধিকার আছে। আমরা মনে করি, যৌথ বাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারে না।’
আনুষ্ঠানিকভাবে অপারেশন ক্লিন হার্ট বন্ধ এবং মাত্র তিন বছর আগে হাইকোর্টের এই পর্যবেক্ষণের পরেও সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধার অভিযান কখনোই বন্ধ হয়নি। আর মাদকের বিস্তার বাড়লে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় মাদকবিরোধী অভিযান। মাঝে ধর্ষণের অভিযোগেও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ‘হারকিউলিস’–এর নাম দিয়ে সেই হত্যাকাণ্ডকে ‘রবিনহুড’ ধরনের বীরের কাজ হিসেবে প্রচার করারও চেষ্টা হয়েছে।
সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার, অস্ত্র উদ্ধার বা মাদকবিরোধী অভিযান—যে নামেই অভিযান চলুক, এর সুযোগ নেওয়ার উদাহরণ বা অপব্যবহারের অভিযোগ বাংলাদেশেও আছে। আর্জেন্টিনার সেই আর্কিমিডিস পুচ্চিওর মতো মানুষ আছে সব দেশেই। রাষ্ট্রের নির্দেশে কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে অনেকেই তা নিজের স্বার্থেও ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশে এর বড় উদাহরণ ২০১৪ সালের নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) তিন সামরিক কর্মকর্তার হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছিলেন সাতজন। খুন করে সবাইকে শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সাতজনকে গুম করার ওই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া যায়নি। ব্যাপক সমালোচনার মুখে র্যাব কর্মকর্তাদের বিচারের সম্মুখীন করা হয়। একইভাবে আলোচিত আরেকটি তথাকথিত ক্রসফায়ারের শিকার ছিলেন টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর ও স্থানীয় যুবলীগের সাবেক সভাপতি মো. একরামুল হক। ধরে নেওয়ার সময়ের কথোপকথনের অডিও ফাঁস হয়ে গেলে ২০১৮ সালে এ নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সরকারি সংস্থা জাতীয় মানবাধিকার কমিশন থেকেও একে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলা হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল র্যাবের বিরুদ্ধে। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন নেতা এভাবে মারা গেলেও এর কোনো সুরাহা হয়নি।
মাদকবিরোধী অভিযানের সর্বশেষ আলোচিত ঘটনা হচ্ছে টেকনাফে পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা। ফিলিপাইনে একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীকে অপহরণ ও গুম করে সেখানকার পুলিশ যেমন বিপাকে পড়েছিল, টেকনাফ পুলিশও এখন একই রকম অবস্থার মধ্যে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ সাত পুলিশ সদস্যকে।
রাষ্ট্রীয় কৌশলের অংশ হিসেবে যুগে যুগেই বিচারবহির্ভূত হত্যার অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে ব্যক্তিস্বার্থে এর ব্যবহার। ‘ক্রসফায়ার’-এর ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের ঘটনার উদাহরণ বাংলাদেশেই অনেক আছে। মাঝেমধ্যে প্রভাবশালী কেউ এর শিকার হলে তবেই এ নিয়ে আলোচনা হয়, হইচই শুরু হয়। যে কারণে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, সে কারণেই হয়তো সাবেক এক সেনাসদস্যের হত্যার ঘটনায় ‘পুলিশ অত্যন্ত মর্মাহত’ হয়েছে এবং ‘পুলিশের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, এটাই শেষ ঘটনা। ভবিষ্যতে এই ধরনের কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।’
এতে এখন যদি কেউ আশ্বস্ত হতে চান, সেটি তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়।