রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় গম গবেষণাকেন্দ্রের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনোয়ার শহিদকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারীকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব। তাঁর নাম মো. জাকির হোসেন।
র্যাব জানায়, খুনের পরিকল্পনা করেই গত বুধবার দিনাজপুর থেকে ঢাকা আসেন হত্যার পরিকল্পনাকারীরা। ঢাকায় এসে উঠেন কল্যাণপুরের একটি আবাসিক হোটেলে। হত্যার আগের দিন আনোয়ার শহিদের বাসায় গিয়ে দেখা করেন জাকির হোসেন। পরদিন শ্যামলী এলাকায় তাঁকে আসার অনুরোধ করে চলে আসেন জাকির। দেখা করার কারণ, যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনার পর তাঁকে ধরতে না পারেন। দেখা করে পরদিন শ্যামলী এলাকায় আসার অনুরোধ করে চলে আসেন জাকির হোসেন। হোটেলে ফিরে ‘খুনি’ সাইফুল ইসলামের সঙ্গে বসে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। পরে হোটেলের পাশের দোকান গিয়ে একটি ছুরি কেনেন তাঁরা।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কল্যাণপুরের বাসা থেকে আনোয়ার শহিদ শ্যামলীতে আসেন। বাসায় বলে আসেন দিনাজপুর থেকে একজন দেখা করতে এসেছেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। শ্যামলীতে এসে জাকির হোসেনের সঙ্গে দেখা করেন। জাকির কেনাকাটার কথা বলে স্থানীয় একটি সুপারশপে নিয়ে যান তাঁকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মার্কেট থেকে বের হয়ে গলিতে যান তাঁরা। সেখানে আগে থেকে প্যান্টের পকেটে ছুরি নিয় ওত পেতে ছিলেন সাইফুল ইসলাম। গলিতে এসেই কিছুটা দূর থেকে সাইফুলকে ইশারা দেন জাকির হোসেন। জাকিরের ইশারা পেয়ে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার সামনে গিয়ে ছুরিকাঘাত করে হোটেলে ফিরে আসেন সাইফুল ইসলাম। তাঁকে ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনাটি সেখানের একটি ভবনের সিসিটিভিতে ধরা পড়ে।
র্যাব জানায়, খুন করে হোটেলে ফিরে শার্ট, প্যান্ট পরিবর্তন করে দিনাজপুর যাওয়ার জন্য টিকিট কাটতে গাবতলী বাস কাউন্টারে যান তাঁরা। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ ও বাস কাউন্টারের ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাঁরা জামা–কাপড় পরিবর্তন করেছেন। তবে হত্যার পরিকল্পনাকারী জাকির হোসেন তাঁর পায়ের জুতা পরিবর্তন করেননি। সেই পায়ের জুতার সূত্র ধরে জাকিরকে শনাক্ত করা হয়।
গতকাল রোববার রাজধানীর গাবতলী এলাকা থেকে জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযুক্ত সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। আজ সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নিহত বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা দিনাজপুর কর্মরত থাকা অবস্থায় জাকিরের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। দিনাজপুরে জমি কেনার সময় জাকির দালাল হিসেবে মধ্যস্থতা করেন
আল মঈন বলেন, জাকির হোসেন বিভিন্ন সময় নিহত আনোয়ার শহিদের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা ধার হিসেবে নিয়েছিলেন। নিহত ব্যক্তি অবসর গ্রহণের পর ঢাকায় বসবাস শুরু করলেও ঘনিষ্ঠতার সুবাদে জাকিরের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে যোগাযোগ হতো। এক বছর আগে জাকির হোসেন নিজের চালের গোডাউন বন্ধক রেখে ২০ লাখ টাকা ঋণ পাইয়ে দিতে তাঁর (বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা) সহযোগিতা চান। তাঁকে সহযোগিতা করতে রাজি হননি তিনি। এ ছাড়াও পাওনা টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য জাকিরকে চাপ দেন। এ লেনদেন সম্পর্কে আনোয়ার শহিদ ও জাকির হোসেন ছাড়া কেউ জানতেন না। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জাকির ছয়–সাত মাস আগে শহিদকে হত্যার পরিকল্পনা করেন, যাতে ধার করা টাকা ফেরত দেওয়া না লাগে।
আল মঈন আরও বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী জাকির তাঁর চালের চাতালশ্রমিক সাইফুল ইসলামকে হত্যার জন্য ভাড়া করেন। এ ঘটনার তিন–চার মাস আগে তাঁরা বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাকে হত্যার চেষ্টা করেন। তখন ঘটনাস্থলে পুলিশ ও অতিরিক্ত লোকজন থাকায় তাঁরা ব্যর্থ হন।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, ঘটনার পর তাঁরা একসঙ্গে দিনাজপুরে যাওয়ার জন্য বাসের টিকিট কাটেন। রাত আটটার বাসে তাঁদের দিনাজপুর যাওয়ার কথা ছিল। দিনাজপুর থেকে এক ব্যক্তি জাকির হোসেনকে ফোন দিয়ে জানান আনোয়ার শহিদ ছুরিকাঘাত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। দিনাজপুরে না গিয়ে নিজেকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখতে হাসপাতালে যান জাকির। এরপর দিনাজপুর চলে যান। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর তাঁরা দুজন দিনাজপুর থেকে আত্মগোপনে চলে যান। তাঁরা এ সময় বেশ কয়েকটি স্থান পরিবর্তন করেন। সর্বশেষ তাঁরা গাবতলী এলাকায় এসে আত্মগোপনে যান। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সেখান থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে আদাবর থানায় নিহত ব্যক্তির ছোট বোন ফেরদৌস সুলতানার করা হত্যা মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
র্যাব সূত্র জানায়, চাকরিজীবনে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দিনাজপুরে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৭৬ সালে গম গবেষণাকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি শুরু করেন। সর্বশেষ গাজীপুরের জয়দেবপুর গম গবেষণাকেন্দ্র থেকে ২০০৮ সালে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর কল্যাণপুরে বোনের বাসায় থাকতেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর ডোমারে। স্ত্রী ও সন্তান না থাকায় তিনি তাঁর চাকরিজীবন থেকে দিনাজপুর ও নিজ এলাকার গরিব মানুষদের সহায়তা করতেন। আত্মীয়স্বজনদেরকেও তিনি নিয়মিত আর্থিক সহায়তা দিতেন।
র্যাব আরও জানায়, জাকির হোসেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার জমি–জমার সব তথ্য জানতেন। যেহেতু তাঁর কোনো সন্তান ছিল না, তাই তাঁকে হত্যার পর জমির নকল কাগজপত্র বানিয়ে আত্মসাতের পরিকল্পনা ছিল জাকিরের।