বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) দুর্নীতির কারণে দেশের বিমানবন্দরগুলোর অবস্থা নাজুক বলে মনে করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির বিভিন্ন পর্যায়ের দুর্নীতির কারণে যাত্রীসেবা নিম্নগামী ও নিরাপত্তা ঝুঁকি ঊর্ধ্বগামী হয়েছে বলেও মনে করে দুদক।
বেবিচকের কার্যক্রম নিয়ে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক দলের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বেবিচকের দুর্নীতির ১১টি উৎস চিহ্নিত করে সেগুলো প্রতিরোধে ১১টি সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি আজ রোববার সচিবালয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর কাছে হস্তান্তর করেছেন দুদকের কমিশনার মোজাম্মেল হক খান।
এ সময় দুদক কমিশনার বলেন, দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক দল বেবিচকের ক্রয় খাত, সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা, নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক কাজ, পরামর্শক নিয়োগ, বিমানবন্দরের স্পেস/স্টল ও বিলবোর্ড ভাড়া, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজসহ ১১টি খাতে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করেছে।
দুদক কমিশনার আরও বলেন, ২৫ টি প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান আইন, বিধি, পরিচালনাপদ্ধতি, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ-অপচয়ের দিক পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক দল গঠন করে। দলগুলোকে এসব প্রতিষ্ঠানের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সফলতা ও সীমাবদ্ধতা, আইনি জটিলতা, সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি ও দুর্নীতির কারণ চিহ্নিত করে তা বন্ধে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। কমিশনের নির্দেশনার আলোকে এসব দল প্রতিবেদন দাখিল করছে। ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে জানিয়ে দুদক কমিশনার বলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এ সময় প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী দুদকের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, শুধু দুর্নীতি নয়, যাঁরা কাজে অবহেলা করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। এই মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতিবাজদের স্থান নেই।
দুদক সূত্র জানায়, বেবিচক নিয়ে গঠিত প্রাতিষ্ঠানিক দলটি সংস্থাটির অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বর্তমানে বিভিন্ন শাখায় কর্মরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে তথ্য সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, গণমাধ্যমের কর্মী, টিআইবিসহ বিভিন্ন গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানে গিয়ে এ-সংক্রান্ত তাদের বক্তব্য এবং সংগৃহীত রেকর্ডপত্র ও তথ্য পর্যালোচনা করেছে। বেবিচকের উপদেষ্টাদের সঙ্গে দেখা করে নানা তথ্য ও পরামর্শ নিয়েছে। অনুসন্ধানকালে বেবিচকের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যসহ ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক বিবৃতি, নিরীক্ষা ও অডিট প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরামর্শ নেয়। সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে প্রাতিষ্ঠানিক দলটি তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে।
দুদক বলছে, বেবিচকের টাওয়ার, বোর্ডিং ব্রিজসহ বড় কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়। ঠিকাদারেরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বড় অঙ্কের ঘুষ দিয়ে নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এ ক্ষেত্রে ঠিকাদারেরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর জন্যও অর্থ লগ্নি করে থাকেন।
দুদকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক কাজের খাতটি বেবিচকে দুর্নীতির আখড়া হিসেবে বিবেচিত। এখানকার অধিকাংশ প্রকৌশলীর বিদেশে একাধিক বাড়ি আছে বলে জনশ্রুতি আছে। কাগজপত্র ঠিক রেখে কাজের মানে হেরফের করে যেনতেনভাবে কাজ করে ঠিকাদার ও প্রকৌশলীদের টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। দুদক বলছে, দু-একজন ভালো ও সৎ প্রকৌশলী থাকলেও অসৎদের দাপটে তাঁরা পদোন্নতি ও যথাযথ পদায়নবঞ্চিত। বিপরীতে ভালো ঠিকাদারেরা যখন কোনো টেন্ডারের কাগজপত্র জমা দেন, প্রায়ই প্রয়োজনীয় এক বা একাধিক কাগজ গায়েব করে দিয়ে তাঁদের টেন্ডার-প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়।
স্থাবর সম্পত্তির মালিকানার দিক থেকে দেশের অন্যতম ধনী প্রতিষ্ঠান হলেও বেবিচকের এই সম্পত্তিগুলোর কোনো ধরনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই। প্রচুর সম্পত্তি অবৈধ দখলে থাকলেও দখলদারদের সঙ্গে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশের কারণে নিয়মতান্ত্রিক উচ্ছেদসহ যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায় করে।
বিমানবন্দরের স্পেস, স্টল ও বিলবোর্ড ভাড়ায় দুর্নীতি রয়েছে বলে দুদকের প্রতিবেদন বলছে। তারা বলছে, দেশের প্রধান বিমানবন্দরকে একটি দেশের ড্রয়িং রুম বলা যায়। বিদেশি যাত্রীরা বিমানবন্দরে নেমে এর সার্বিক অবস্থা দেখে দেশ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেয়ে থাকেন। কিন্তু হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একমাত্র ডিউটি ফ্রি শপগুলো ছাড়া অন্যান্য দোকান ও স্টল পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। সম্পত্তি শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মালিকানায় ব্যাঙের ছাতার মতো বিমানবন্দরের ভেতরে ও বাইরে টং দোকান গড়ে উঠেছে, যেগুলো কোনোভাবেই একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সঙ্গে মানানসই নয়। একেকটি দোকান মাত্র ৫০ থেকে ১০০ বর্গফুট জায়গা ভাড়া নিয়ে নিম্নমানের খাদ্যপণ্যসহ যেকোনো জিনিস কয়েকগুণ দামে বিক্রি করে। পণ্যের খুচরা মূল্যের অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ নেওয়ার মতো কোনো ধরনের সেবা তারা দিতে পারে না। এর ফলে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার পাশাপাশি খাবার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে।
দুদকের পর্যবেক্ষণ হলো, এসব দোকান ও স্টলের যথার্থতা নির্ধারণের জন্য এর আগে মন্ত্রণালয়ে ফাইল চালাচালি হলেও অজ্ঞাত কারণে তা থেমে যায়। এর বাইরে বিমানবন্দরের যেখানে-সেখানে বিলবোর্ডের পরিমাণ এত বেশি যে, বিলবোর্ডের কারণে প্রয়োজনীয় সাইনেজও যাত্রীদের চোখে পড়ে না। অধিকাংশ বিলবোর্ডই মানসম্মত নয়। যোগসাজশ করে এসব অপ্রয়োজনীয় বিলবোর্ড ভাড়া দেওয়া হয়েছে বলে দুদক বলছে।
দুদকের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বেবিচকে কেনাকাটাসহ বিভিন্ন নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনায় চুক্তিভিত্তিক অনেক পরামর্শক নিয়োগ করা আছে। এসব খাতে পরামর্শকের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও এ যাবৎকালের অনেক পরামর্শকের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন সব সময়ই ছিল। প্রতিষ্ঠানটিতে দেখা যায়, বিভিন্ন সময় প্রেষণে এসে বেবিচকে সাময়িক চাকরি করে যাওয়া অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকৃত অভিজ্ঞ পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয় না। এতে পরামর্শকদের জন্য বেবিচকের টাকা খরচ হলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না বলে মনে করছে দুদক।
বেবিচকের আয়ের বড় অংশ বিদেশে কর্মকর্তাদের ব্যয়বহুল প্রশিক্ষণে খরচ হয়। অনেক কর্মকর্তা প্রেষণে এসে এক-দুই বছর বেবিচকে কাজ করার সময় প্রায় প্রতিমাসেই একাধিক বিদেশ প্রশিক্ষণে ব্যস্ত থাকেন। পরে বদলি হয়ে গেলে নতুন কর্মকর্তা প্রেষণে এসে একই প্রশিক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে এসব ব্যয়বহুল প্রশিক্ষণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের কাজে আসে না।
যাত্রী অধিকার নিশ্চিত করার জন্য দুনিয়াজুড়ে কার্যকর আছে মনট্রিল কনভেনশন। এতে হারানো মালামালে ক্ষতিপূরণ থেকে শুরু করে দুর্ঘটনাকবলিত যাত্রীদের ক্ষতিপূরণসহ যাবতীয় ক্ষতিপূরণের নিম্নসীমা বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে প্রণীত এই কনভেনশনে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও ২০০৩ সালে স্বাক্ষর করেছে। পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশ (৯৫ শতাংশ) এটি কার্যকর করলেও অজ্ঞাত কারণে বাংলাদেশের পক্ষে এখনো তা করা হয়নি। পৃথিবীর গুটিকয়েক অনগ্রসর দেশের মতো বাংলাদেশ এখনো ১৯২৯ সালে প্রণীত সেকেলে ওয়ারশ কনভেনশন বলবৎ রেখেছে।
মনট্রিল কনভেনশনে কোনো যাত্রীর মালামাল খোয়া গেলে তার মূল্যমানের হিসাবে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। কিন্তু ওয়ারশ কনভেনশনে কেজিপ্রতি মাত্র ২০ ডলার নির্ধারণ করা আছে। দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মনট্রিল কনভেনশনে যাত্রীপ্রতি ১ থেকে ২ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। ওয়ারশ কনভেনশনে মাত্র ২৫ হাজার মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেকেলে ওয়ারশ কনভেনশনের অসামঞ্জস্যতা ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দেশি একাধিক বিমান সংস্থা পুরোনো ক্যারিয়ার দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ফ্লাইট চালাচ্ছে। ইনস্যুরেন্সের দোহাই দিয়েই এসব ক্যারিয়ার চলমান বলে দুদকের পর্যবেক্ষণ। এর ফলে মনট্রিল কনভেনশন বাস্তবায়ন না করায় একদিকে যেমন যাত্রীসাধারণ তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। বিগত ১৫ বছরেও মনট্রিল কনভেনশন কার্যকর করতে না পারার দীর্ঘসূত্রতার পেছনে বেবিচকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিমান প্রতিষ্ঠানগুলোর অযাচিত আর্থিক লেনদেনের প্রভাব রয়েছে মর্মে ধারণা করছে দুদক।
প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের নামে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয় বলে দুদকের প্রতিবেদন বলছে। এ খাতে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়। উদাহরণ হিসেবে তারা বলছে, ২০১৩ সালে ফ্লাইট সেফটির অফিস মডেলিং করা হয়। কিন্তু আবার কয়েক কোটি টাকা খরচ করে ওই দপ্তরকে রি-মডেলিং করা হয়, যার কোনো প্রয়োজন ছিল না এবং তাতে শুধু সরকারি অর্থের অপচয় হয়।
পাইলট, ফ্লাইং ইঞ্জিনিয়ার ও এয়ারক্রাফটের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয় বলে মনে করছে দুদক। তাদের পর্যবেক্ষণ হলো, বিভিন্ন এয়ারলাইনসের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক গ্যারান্টি বা ক্যাশ লিমিট দেওয়া থাকে। এ লিমিট অতিক্রম করলে লাইসেন্স বাতিল হওয়ার বিধান রয়েছে। লিমিট অতিক্রম হলে এবং সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনস নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত টাকা পরিশোধ না করলে ওই এয়ারলাইনসের লাইসেন্স বাতিল হওয়ার কথা থাকলেও বেবিচকের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অসাধু কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ঠুনকো অজুহাতে অনেক এয়ারলাইনসের লাইসেন্স দীর্ঘকাল ধরে বাতিল করছে না। এ সুযোগে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর বকেয়া টাকার পরিমাণ দিনে দিনে পাহাড়সম হচ্ছে এবং সরকার আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া ফ্লাইং ইঞ্জিনিয়ারদের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতা বা দক্ষতার চেয়ে স্বজনপ্রীতি, পছন্দের প্রার্থী, দলীয় বিবেচনা ও টাকার দৌরাত্ম্য বেশি প্রাধান্য পায়। অনেক ক্ষেত্রে অসাধু কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সংস্থার শর্তাদি পরিপালন না করে প্রাইভেট এয়ারক্রাফটের লাইসেন্স দেন, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এতে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।
কোনো এয়ারলাইনস যদি দেশের ভেতরে বা বাইরে নতুন করে ফ্লাইট পরিচালনা করতে চায় কিংবা ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়াতে চায় বা শিডিউল পরিবর্তন করতে চায়, সে ক্ষেত্রে বেবিচকের কাছে আবেদন করতে হয়। শর্তাদি পূরণ সাপেক্ষে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলারের অনাপত্তিক্রমে ফ্রিকোয়েন্সি বা শিডিউল অনুমোদন করার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা টাকার বিনিময়ে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলারের অনাপত্তি না নিয়ে অনুমোদন দেয়। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের পছন্দমতো সময়ে শিডিউল পেয়ে যায়। এতে সন্ধ্যার পর ফ্লাইটের সংখ্যা এতই বেড়ে যায় যে বাংলাদেশ বিমান যথাসময়ে গ্রাউন্ড হ্যান্ডল করে পেরে ওঠে না। তখন যাত্রী দুর্ভোগ মারাত্মক আকার ধারণ করে।
দুদকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে বেবিচকের অপারেশনাল কাজে সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা। সংস্থাটির দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোর অবস্থা নাজুক। এয়ারলাইনসগুলোকে উড্ডয়নের অনুমতি দেওয়ার সময় নির্ধারিত সাইকেলে নিয়ম অনুযায়ী সি-চেক, ডি-চেকসহ বিবিধ গুরুত্বপূর্ণ শর্ত বেঁধে দেওয়া হলেও কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে তারা বিদ্যমান শর্ত অনায়াসে লঙ্ঘন করে। আগে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ১ নম্বর ক্যাটাগরিতে ছিল। এতে বাংলাদেশের বিমান সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে চলাচল করতে পারত। কিন্তু শর্তাদি না মানা এবং বিমানবন্দরের নিরাপত্তা দুর্বলতা, সোনা-মাদক চোরাচালানের কারণে দেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনিক কাজে মারাত্মক সমন্বয়হীনতা যাত্রী দুর্ভোগকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। বর্তমানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ২ নম্বর ক্যাটাগরিতে আছে। ফলে সরাসরি দেশের বিমান যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারছে না।
দুর্নীতি প্রতিরোধে ১১ দফা সুপারিশ
বুয়েটের শিক্ষকসহ অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ক্রয় কমিটি গঠন করে ক্রয়ের মান ও মূল্যের যথার্থতা নির্ণয়ের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে দুদক। পাশাপাশি অতীতের কেনাকাটায় দুর্নীতি খতিয়ে দেখার জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা উচিত।
নির্মাণকাজ মূল্যায়নের জন্য বুয়েটের শিক্ষকসহ বিভিন্ন সংস্থার অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে নিরপেক্ষ মেয়াদি কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
দুদক বলছে, বেবিচকে একটি সম্পত্তি অধিশাখা থাকলেও পরিচালক বা সমপর্যায়ের কর্মকর্তা নেই। নিয়মতান্ত্রিকভাবে সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার জন্য অভিজ্ঞ পরিচালক পদায়ন করা যায়। সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও অবৈধ দখলদারমুক্ত করার জন্য একটি সর্বাত্মক পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।
বিমানবন্দরে দোকান ও বিলবোর্ডগুলো বরাদ্দ দেওয়ার যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখার কথা বলছে দুদক। অযৌক্তিক বরাদ্দের ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাতিলসহ বরাদ্দ প্রদানকারী এবং মতামত প্রদানকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছে। যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দোকান নিয়ে ব্যবসা করছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে বিধিমতে ব্যবস্থা নিতে হবে। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ডেস্কে অতীত রেকর্ড দেখে স্বচ্ছ কর্মকর্তাদের পদায়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
একটি গ্রহণযোগ্য কমিটি গঠন করে যাত্রীদের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য মানসম্মত পণ্যদ্রব্য বিক্রির শর্তসাপেক্ষে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সঙ্গে মানানসই দোকান বা স্টল বরাদ্দ দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। ১০টি অপ্রয়োজনীয় দোকান বরাদ্দ না দিয়ে একটি মানসম্মত প্রয়োজনীয় দোকান বরাদ্দ দিতে হবে। যাত্রীদের প্রয়োজন, অধিকার, সুবিধা এবং বিমানবন্দরের সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিতে হবে।
পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে। এযাবৎকালে নিয়োগকৃত পরামর্শকদের নিয়োগপ্রক্রিয়া খতিয়ে দেখতে হবে।
বেবিচকের নিজস্ব কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং ভিন্ন সংস্থা থেকে প্রেষণে পদায়ন নিরুৎসাহিত করতে হবে।
মনট্রিল কনভেনশন কেন এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি, তা খতিয়ে দেখার জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা উচিত। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কারকাজ এবং সব কেনাকাটার ক্ষেত্রে ই-টেন্ডারিং ব্যবস্থা চালু ও তা নিশ্চিত করতে হবে।
ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ও এয়ার লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির ক্ষেত্র চিহ্নিত করে এর বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি ও শিডিউল অনুমোদনের জন্য আবশ্যিকভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার তথা বাংলাদেশ বিমানের অনাপত্তিপত্র নিতে হবে। যেসব ক্ষেত্রে অনাপত্তি নেওয়া হয়নি, সেসব ক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
দক্ষ ব্যক্তিদের যথাযথ জায়গায় পদায়ন করতে হবে। বিমানবন্দরে অপারেশনাল কাজের জন্য দক্ষ অফিসারের পাশাপাশি প্রশাসনিক কাজের জন্য দক্ষ প্রশাসন বা সমন্বয়ক নিয়োগ দিতে হবে।