বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক নারী শিক্ষার্থীকে মেসেঞ্জারে বুয়েটেরই আরেক শিক্ষার্থী অর্ধনগ্ন ছবি ও অশ্লীল ভিডিও পাঠিয়ে, আপত্তিকর বিভিন্ন ইমোজি ব্যবহার এবং কমেন্টের মাধ্যমে যৌন হয়রানি করেছেন। আর অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে এসব করতে উসকানি দিয়েছেন আরও তিন শিক্ষার্থী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে চার ছেলে শিক্ষার্থীর ছবি এবং তাঁদের মেসেঞ্জারের কথোপকথনের স্ক্রিনশট ঘুরছে। এগুলো ছড়িয়ে দিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এতে পক্ষ-বিপক্ষে আলোচনা, সমালোচনাও চলছে।
যৌন হয়রানির শিকার ওই নারী শিক্ষার্থী প্রথমে বিষয়টি নারীদের একটি গ্রুপে শেয়ার করেন। পরে তা অন্য শিক্ষার্থীরাও জানতে পারেন এবং আন্দোলন শুরু হয়।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে লকডাউনে ভার্চ্যুয়ালি চলছে আন্দোলন। ২২ জুলাই এক আলোচনায় চার শিক্ষার্থী বিষয়টিকে নিছক মজা বা ক্ষতিকারক কোনো উদ্দেশ্যে তাঁরা তা করেননি বলে বিভিন্ন যুক্তি দিতে থাকেন। তবে তত দিনে স্ক্রিনশট দেখে ঘটনাটি আসলে কী ছিল, তা বুঝতে কারও আর বাকি ছিল না। তাই ২৩ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। সাধারণ শিক্ষার্থীরা চার অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বয়কট করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
নারী শিক্ষার্থীর সহপাঠী যাঁরা যৌন হয়রানির ঘটনায় আন্দোলন করছেন, তাঁরা বলছেন, ফেসবুকে চার ছেলে শিক্ষার্থীর ছবি ছড়িয়ে দিতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন। এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও যথাযথ বিচার পাওয়া যায় না বা বিচারহীনতার সংস্কৃতির জন্যই তাঁরা এটা করতে বাধ্য হয়েছেন। অবশ্য বুয়েটের পক্ষ থেকেও যৌন হয়রানির অভিযোগে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত শেষে ঘটনার বিচার পাবেন ভুক্তভোগী।
ট্রল থেকে রেহাই পাচ্ছে না বুয়েট এবং ওই চার শিক্ষার্থী বুয়েটে ভর্তির আগে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন, সেসব প্রতিষ্ঠান। বুয়েটের শিক্ষার্থীদের ফেসবুকে ‘বুয়েটিয়ান’সহ বিভিন্ন গ্রুপে এবারের ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেভাবে একজোট হয়ে আন্দোলনে নেমেছেন, তার প্রশংসাও চলছে। ফেসবুকে সাহস করে বিষয়টি শেয়ার করেছেন বলেই তা সবাই জানতে পারছে। ফলে এতে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে বলে মনে করছেন না তাঁরা। কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা ঘটে না, তাই নিয়েও তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন। তাই ট্রলের বিষয়টি তাঁরা পাত্তা দিচ্ছেন না।
বুয়েটের একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়েছে প্রথম আলোর। তাঁরা বলছেন, বুয়েটে এর আগেও ‘টুনটুনি স্ক্যান্ডাল’সহ এ ধরনের অনেক ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার নজির আছে। অনেক ঘটনাই বুয়েটের চৌহদ্দির বাইরে আর কেউ জানার সুযোগই পায়নি। তবে আর নয়। বিকৃত আচরণকারীদের পরিচয় প্রকাশ করেই প্রতিবাদ করতে হবে। আর এতে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।
বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক মো. মিজানুর রহমান আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, যৌন হয়রানির শিকার মেয়ে বা তাঁর পরিবার এখন পর্যন্ত সরাসরি বা ই-মেইলে কোনো অভিযোগ করেননি। তবে মেয়ে শিক্ষার্থীর ক্লাস প্রতিনিধির মাধ্যমে তাঁর বিভাগের অন্য শিক্ষার্থীরা ই-মেইলে প্রথমে বিভাগের প্রধান বরাবর অভিযোগ করেন। বিষয়টি নজরে আসার পর ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পক্ষ থেকে অভিযোগের হার্ড কপি ও সফট কপি বুয়েটের উপাচার্য বরাবর পাঠানো হয়েছে। জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি আজ থেকেই কাজ শুরু করবে। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী বুয়েটের যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে গঠিত কমিটিও বিষয়টি অবগত আছে। তদন্ত শেষে যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ প্রমাণের আগেই চার শিক্ষার্থীর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিষয়টি নিয়ে আমরাও বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে আছি। তবে ফেসবুকের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না বা বাক্স্বাধীনতার কথা চিন্তা করে তা করাও যায় না। ফেসবুক ব্যবহারে অন্য কারও অনুভূতিতে যাতে আঘাত না লাগে, মানবাধিকার লঙ্ঘন না হয়, তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সময় সতর্ক থাকার অনুরোধ জানানো বা পরামর্শ দেওয়া হয়। চার শিক্ষার্থীর সবাই দোষী কি না, তাঁরা আবার ডিজিটাল আইনের আশ্রয় নেবেন কি না, এসব বিষয়ও জড়িত।’
এ পর্যন্ত অভিযোগ পাওয়া ঘটনাগুলো ছিল সরাসরি যৌন হয়রানি করেছে, এমন ঘটনার। তবে এবারের ঘটনাটি হচ্ছে অনলাইনে যৌন হয়রানি, সেদিক থেকে বিষয়টিও অনেকটা নতুন। তদন্ত কমিটি বিভিন্ন দিক বিবেচনা করেই তদন্ত করবে বলে উল্লেখ করেন মো. মিজানুর রহমান।
ফেসবুকে যৌন হয়রানির বিষয়টির পাশাপাশি নীতি-নৈতিকতা, শিক্ষার মান, অভিভাবকদের দায়—কোনো কিছুই বাদ যাচ্ছে না আলোচনা থেকে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, শুধু বুয়েট নয়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এ ধরনের ঘটনা ঘটেই চলছে। কোনোটি নজরে আসে, কোনোটি নজরে আসে না। আইনি প্রক্রিয়ায় গেলে বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে তা ঝুলে থাকে বছরের পর বছর।
অভিযুক্ত চার শিক্ষার্থীর বিকৃত মানসিকতা প্রসঙ্গে (স্ক্রিনশট অনুযায়ী যেটুকু নজরে এসেছে) রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, শিক্ষাব্যবস্থা থেকে মূল্যবোধ ও নীতি–নৈতিকতার বিষয়গুলো হারিয়ে গেছে। পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—এই তিন জায়গায় মূল্যবোধের দুর্বলতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। মধ্যবিত্ত সমাজে ঘুণে ধরার বিষয়টি অশনিসংকেতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষায় শুধু জিপিএ-৫–এর পেছনে দৌড়ানো বা পরীক্ষানির্ভরতা নিয়ে আত্মজিজ্ঞাসার সময় এসেছে। যৌন হয়রানির ঘটনার পর পক্ষে-বিপক্ষে ফেসবুকে বিতর্ক শুরু হয়েছে, অথচ এটা তো বিতর্কের কোনো বিষয় নয়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সন্তানকে বুয়েট বা সুপ্রতিষ্ঠিত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করলেই অভিভাবকদের দায় শেষ হয় না, একইভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও দায় এড়াতে পারে না।
কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালে হাইকোর্ট ১১টি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেন। ওই রায়ে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগকেন্দ্র এবং তা পরিচালনার জন্য ন্যূনতম পাঁচ সদস্যের কমিটি থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ নির্দেশনা অনুযায়ী যৌন হয়রানি বলতে বোঝায়—অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আবেদনমূলক আচরণ (সরাসরি কিংবা ইঙ্গিতে) যেমন, শারীরিক স্পর্শ বা এ ধরনের প্রচেষ্টা। প্রাতিষ্ঠানিক এবং পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা, যৌন হয়রানি বা নিপীড়নমূলক উক্তি, যৌন সুযোগ লাভের জন্য অবৈধ আবেদন, পর্নোগ্রাফি দেখানো, যৌন আবেদনমূলক মন্তব্য বা ভঙ্গি, অশালীন ভঙ্গি, যৌন নির্যাতনমূলক ভাষা বা মন্তব্যের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা, কাউকে অনুসরণ করা বা পেছন পেছন যাওয়া, যৌন ইঙ্গিতমূলক ভাষা ব্যবহার করে ঠাট্টা বা উপহাস করা, চিঠি, টেলিফোন, মোবাইল, এসএমএস, ছবি, নোটিশ, কাটুন, বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিল, নোটিশ বোর্ড, অফিস, ফ্যাক্টরি, শ্রেণিকক্ষ, বাথরুমের দেয়ালে যৌন ইঙ্গিতমূলক অপমানজনক কোনো কিছু লেখা,
ব্ল্যাকমেল অথবা চরিত্র লঙ্ঘনের উদ্দেশ্য স্থির বা চলমান চিত্র ধারণ করা, যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির কারণে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং শিক্ষাগত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হওয়া, প্রেম নিবেদনে করে প্রত্যাখ্যান হয়ে হুমকি দেওয়া বা চাপ প্রয়োগ করা এবং ভয় দেখিয়ে বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা স্থাপনে চেষ্টা করা।
বুয়েটের নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রধান অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর কথোপকথনের যে স্ক্রিনশট ফেসবুকে ছড়িয়ে আছে, তাতে দেখা যায়, নারী শিক্ষার্থী বিরক্তি প্রকাশ করেছেন প্রাথমিক পর্যায়ে। এরপরও একই আচরণ করতে থাকলে পুলিশে অভিযোগ জানাতে বাধ্য হবেন বলেও জানিয়েছেন। ওই অভিযুক্ত শিক্ষার্থী তাঁর আচরণের জন্য ক্ষমা চাইলেও তিনি থামেননি।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রেসিডেন্ট সালমা আলী এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশনায় যৌন হয়রানির অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিচয় গোপন রাখতে হবে বলে বলা আছে। বুয়েটের ঘটনায় ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া স্ক্রিনশটগুলোকে প্রমাণ হিসেবেই বলা যায়। ওই নারীকে উত্ত্যক্ত করা হয়েছে, তা তো স্পষ্ট। উসকানিদাতাদের অপরাধও কম না। তবে এরপরও কোনোভাবেই যাতে অন্য কোনো ব্যক্তির মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয়, সেদিকেও সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। আইনি বাধ্যবাধকতাও মানতে হবে। তাই ফেসবুকে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ছবি ছড়িয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’