বিমানবন্দরে কৌশলে ধরিয়ে দেওয়া হয় ইয়াবা, সৌদি গিয়ে ২০ বছরের সাজা

স্বদেশির প্রতারণার শিকার হয়ে সৌদি আরবে গিয়ে মাদকের মামলায় ২০ বছরের সাজা হয়েছে স্বামী মো. আবুল বাশারের, এই পরিস্থিতিতে দেশে সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা স্ত্রী মোছা. রাবেয়া ঢাকায় এসে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন
ছবি: শেখ সাবিহা আলম

বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের মেয়ে মোছা. রাবেয়া আজ মঙ্গলবার সকালে প্রবাসীকল্যাণ ভবনের উল্টো দিকে বসে ছিলেন। সৌদি আরবে তাঁর স্বামী মো. আবুল বাশারের মাদক পাচারের অভিযোগে ২০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। ‘বিনা দোষে’ স্বামীর এই শাস্তি তিনি মানতে পারছেন না।

মোছা. রাবেয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার লোকটা নির্দোষ। সাত মাস সে জেল খাটছে। এখন আবার ২০ বছরের জেল দিছে। আমি যে বাচ্চাটারে নিয়া কী কষ্ট করতেছি, সেইটা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।’

রাবেয়ার অভিযোগ, সৌদি আরবে যাওয়ার পথে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নূর মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তি তাঁর স্বামীর ব্যাগে ইয়াবা ঢুকিয়ে দেন। নূর মোহাম্মদ বিমানবন্দর পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠান একে ট্রেডার্সের এসআর সুপারভাইজার হিসেবে ওই সময় কাজ করতেন। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে নূর মোহাম্মদকে শনাক্ত করে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ গ্রেপ্তারও করে। কিন্তু তিনি গ্রেপ্তারের চার দিন পরই জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসে সবকিছুই জানানো হয়েছিল। তারা যথেষ্ট সক্রিয় ছিল না। সে কারণে তাঁর স্বামীকে এখন কারাভোগ করতে হচ্ছে। হাতে সময় খুব কম। এক মাসের মধ্যে আপিল করতে হবে।
ঠিক কী ঘটেছিল, জানতে চাইলে রাবেয়া বলেন, তাঁর স্বামী আবুল বাশার গত বছরের ডিসেম্বরে ছুটি কাটাতে দেশে আসেন। তাঁর বিয়ে হয়েছে বছর সাতেক আগে। বিয়ের আগে থেকেই তিনি ওখানে কাজ করছেন। ছুটি শেষে ১১ মার্চ দিবাগত রাতে সৌদি আরবে যাওয়ার সময় তিনি ঘটনার শিকার হন।

বিমানবন্দর থানায় দায়ের করা মামলায় মোছা, রাবেয়া লেখেন, মো. আবুল বাশার বহির্গমন টার্মিনালের ৪ নম্বর গেট দিয়ে ওই দিন বিমানবন্দরে ঢোকেন। মালামাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রাত ১২টা ২০ মিনিটের দিকে বিমানের বোর্ডিং পাস সংগ্রহ ও মালামাল তোলার জন্য তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মেঝেতে হাতব্যাগ রাখার পর হঠাৎ নূর মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তি তাঁকে একটি প্যাকেট নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। আবুল বাশার তাঁর অপরিচিত নূর মোহাম্মদের দেওয়া প্যাকেট নিতে অস্বীকার করেন। এ সময় তিনি নিজেকে বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, প্যাকেটটি না নিলে তাঁকে প্লেনে উঠতে দেবেন না।

এই নূর মোহাম্মদ নিজেকে বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে আবুল বাশারকে ইয়াবার প্যাকেট নিতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ রাবেয়ার, পরে বিমানবন্দরের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশও তার প্রমাণ পেয়েছে

নূর মোহাম্মদ শেষ পর্যন্ত আবুল বাশারের ব্যাগের চেইন খুলে তাঁর হাতে থাকা প্যাকেটটি সেখানে ঢুকিয়ে দেন। তিনি বলেন, প্যাকেটের ভেতর আচার ও কিছু খাবার আছে। সৌদি আরবে তাঁর ভাই মো. সাঈদ জেদ্দা বিমানবন্দরে এসে প্যাকেটটি নিয়ে যাবেন। ঘড়িতে তখন সময় রাত ১২টা ৫০ মিনিট। আবুল বাশার ভয় পেয়েছিলেন, হাতে সময়ও ছিল কম। তিনি কথা না বাড়িয়ে প্লেনে ওঠেন। জেদ্দা বিমানবন্দরে পৌঁছালে পুলিশ তাঁর ব্যাগ পরীক্ষা করে ইয়াবা উদ্ধার করে।

আবুল বাশার সৌদি আরবে পৌঁছাতে পেরেছেন কি না, খবর পাচ্ছিলেন না মোছা. রাবেয়া। তবে ১২ মার্চ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অজ্ঞাতনামা একজন জানতে চান, তাঁর স্বামীর কাছে একটি প্যাকেট দেওয়া হয়েছে, তিনি সেটি পৌঁছাতে পেরেছেন কি না? তিন সপ্তাহ পর আবুল বাশার ফোনে পুরো ঘটনা তাঁকে জানান।

রাবেয়া বলেন, ‘আমার স্বামী ফোন দিয়া কাইন্দা উঠছে। বিমানবন্দরে নূর মোহাম্মদ আমার স্বামীকে বলছে, সে তাকে সাহায্য করতে চায়। তখন আমার স্বামী অনেকবার বলেছে, “আমি পুরান লোক, সাহায্য লাগবে না।” তারপর এই ঘটনা ঘটল।’

মোছা. রাবেয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। পরে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে তারাই সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আসামিকে শনাক্ত করে। তাঁকে থানায় মামলা করতেও সহযোগিতা করে। ঢাকা বিমানবন্দর থানায় গত ১৫ এপ্রিল মামলা হয়। কিন্তু রাবেয়া খবর পেয়েছেন, নূর মোহাম্মদ জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

স্বামী আবুল বাশারের সঙ্গে রাবেয়া:

বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, পুরো ঘটনা তাঁরা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসও সবকিছু জানে।

এ বিষয়ে জেদ্দায় লেবার কাউন্সেলর আমিনুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি বলেন, ‘প্রকৃত ঘটনা জানিয়ে আমরা সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি “নোট ভারবাল” দিয়েছি। আমরা জানিয়েছি, আবুল বাশার ঘটনার শিকার। আমরা বিচারিক আদালতেও সব কাগজপত্র পাঠিয়ে বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে দেখার অনুরোধ করেছি।’ পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, জানতে চাইলে আমিনুল ইসলাম বলেন, সৌদি আদালত তাঁর রায় দিয়েছেন গত রোববার। রায়ের কপি তাঁরা হাতে পেয়েছেন। আপিলের প্রস্তুতি চলছে। ন্যায়বিচার নিশ্চিতে যত দূর যেতে হয়, তাঁরা যাবেন।

তবে মোছা. রাবেয়া আর ভরসা রাখতে পারছেন না কারও ওপর। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চিঠি দিচ্ছেন। তার ওপর স্বামী আট লাখ টাকা ঋণ করে গেছেন। ঋণ শোধ করতে মেয়েটিকে কোলে নিয়ে ঢাকায় কাজ খুঁজছেন।