বিভিন্ন বিপণিবিতান, ব্যাংক ও সোনার দোকানে চুরি করাই তাঁদের লক্ষ্য। চুরির নিশানা নির্ধারণের পর সংশ্লিষ্ট এলাকায় তাঁরা বাসা ভাড়া নেন। লক্ষ্যবস্তুর আশপাশে নেন দোকান ভাড়া। দলের এক বা একাধিক সদস্য পরিচয় গোপন করে ভবনে নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি নেন। চাকরি নিতে তাঁরা ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও নাগরিকত্ব সনদ দেখান। সময় নিয়ে পুরো এলাকা ‘রেকি’ করেন তাঁরা। তারপর ‘মিশন’ বাস্তবায়ন করেন। একেকটি ‘মিশন’ বাস্তবায়নে তাঁরা মাসখানেক সময় নেন।
চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে এই কৌশলে চুরি করে আসছে। রাজধানীর একটি জুয়েলার্সে চুরির ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে এই চক্র সম্পর্কে জানতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত ৫ ফেব্রুয়ারি কাফরুলের কচুক্ষেত এলাকার রজনীগন্ধা মার্কেটের রাঙাপরী জুয়েলার্সে এই চুরির ঘটনা ঘটে। মালিক দাবি করেন, তাঁর দোকান থেকে ৩০২ ভরি সোনা, ৩০ লাখ টাকার হীরা ও নগদ ৫ লাখ টাকা চুরি হয়েছে।
চুরির এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মঞ্জুরুল হাসান ওরফে শামীম নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।
চক্রটির ব্যাপারে র্যাবও অনুসন্ধান করছে। র্যাব-৪-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই চক্রের কয়েক সদস্য সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আশা করছি, শিগগির তাঁদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’
ভগ্নিপতি-শ্যালকের চক্র
অনুসন্ধানে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, চোর চক্রটির প্রধান নাসির হোসাইন। তিনি জার্মানিপ্রবাসী। জার্মানিতে বসে তিনি চুরির পরিকল্পনা করেন। চুরির প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় খরচ জোগান দেন। প্রবাসী নাসিরের পরিকল্পনা দেশে বসে বাস্তবায়নে মূল দায়িত্ব পালন করেন তাঁর শ্যালক শামীম।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র জানায়, নাসির দেশে থাকা অবস্থায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চুরি করতেন। চুরি করতে গিয়েই নাসিরের সঙ্গে শামীমের পরিচয় হয়। পরে তিনি শামীমের বোনকে বিয়ে করেন।
চুরির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থের মালিক হন নাসির। চার বছর আগে তিনি জার্মানি যান। সেখানে গিয়ে চুরির পরিকল্পনার পাশাপাশি তা বাস্তবায়নে অর্থায়ন শুরু করেন। তাঁর পরিকল্পনা দেশে বাস্তবায়নে মূল ভূমিকা পালন করেন শামীম।
চুরির পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নাসির জার্মানি থেকে শামীমের কাছে টাকা পাঠান। আবার চুরির মালামালসহ অর্থের দুই ভাগ নাসিরকে পাঠিয়ে দিতেন শামীম।
অন্তত আটজন চিহ্নিত
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায়, নাসির ও শামীম ছাড়াও চোর চক্রটির আরও ছয় সদস্য ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কাউসার মাস্টার ওরফে বাচ্চু, রাজা মিয়া, শ্রীকান্ত ওরফে বাদল, আবুল আকাল আহাদ, খায়রুল ওরফে মনির ও মাসুদ খান। তাঁদের মধ্যে কাউসার দেশে পরিকল্পনা-সংশ্লিষ্ট কাজ করেন। পাশাপাশি তিনি নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে চক্রের সদস্যদের নিয়োগ পেতে সহায়তা করেন। রাজা তালা ভাঙায় দক্ষ। শ্রীকান্ত সোনা যাচাইয়ে পারদর্শী।
তাঁরা ছবি তোলেন না
চক্রটির কোনো কোনো সদস্য ২০ বছরের বেশি সময় ধরে চুরির সঙ্গে জড়িত বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের ভাষ্য, চুরির নতুন পরিকল্পনার পর চক্রের সদস্যরা নতুন মুঠোফোন নেন। তাঁরা অন্যের নামে নিবন্ধন করা সিম ব্যবহার করেন। চুরির পর সেই মুঠোফোন ও সিম নষ্ট করে ফেলেন। এরপর চলে যান আত্মগোপনে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া এড়াতে এই চক্রের সদস্যরা নিজেদের ছবি তোলেন না। পরিবার বা স্বজনের কাছে তাঁদের কোনো ছবি নেই।
‘মিশন’ রাঙাপরী জুয়েলার্স
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার প্রায় এক মাসের বেশি সময় আগে কাফরুলের কচুক্ষেতের রজনীগন্ধা মার্কেটের রাঙাপরী জুয়েলার্সে চুরির পরিকল্পনা করা হয়। নাসিরের পরিকল্পনায় ‘মিশন’ বাস্তবায়ন করেন শামীম। সঙ্গে ছিলেন কাউসার।
শুরুতে ভুয়া পরিচয়ে চক্রের দুই সদস্যকে মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মী করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী, মার্কেটের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি নেন মাসুদ ও খায়রুল। ভুয়া পরিচয়পত্র ও নাগরিকত্বের সনদ তৈরি করে তাঁদের চাকরির ব্যবস্থা করেন কাউসার। চাকরি হওয়ার পর মাসুদ ও খায়রুল একসঙ্গে রাতে নিরাপত্তাকর্মীর দায়িত্ব পালন করতেন। মার্কেটের নিরাপত্তাব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ করে তা তাঁরা শামীম ও কাউসারকে সরবরাহ করেন।
কাউসার ‘নুর ইসলাম’ নাম নিয়ে রজনীগন্ধা মার্কেটে দোকান ভাড়া নেন। দোকানে আসবাব আনার নাম করে তিনি চুরির উপকরণ, তালা ভাঙার সরঞ্জাম আনেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঘটনার দিন রাত ১২টার দিকে মিরপুর-১৪ নম্বর গোলচত্বরে আসেন শামীম, কাউসার, রাজা, শ্রীকান্ত ও আহাদ। সেখান থেকে শামীম মার্কেটের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মাসুদ ও খায়রুলের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন। মাসুদ ও খায়রুল দিবাগত রাত একটার দিকে তাঁদের মার্কেটে যেতে বলেন।
মার্কেটে যাওয়ার পর কাউসারের ভাড়া দোকানে রাজা ও শ্রীকান্তকে নেওয়া হয়। কাউসার ও শামীম মার্কেটের বাইরের চারপাশ নজরদারির দায়িত্ব নেন।
দিবাগত রাত দুইটার দিকে কাউসারের দোকান থেকে তালা ভাঙার যন্ত্রপাতি নিয়ে রাঙাপরী জুয়েলার্সের সামনে যান রাজা। পরে তিনি তালা ভাঙেন। এ সময় নিরাপত্তাকর্মীর দায়িত্বে থাকা মাসুদ ও খায়রুল রাঙাপরী জুয়েলার্সের বাইরে পাহারায় থাকেন। তালা ভেঙে দোকানে ঢোকার এক ঘণ্টার মধ্যে সেখান থেকে অলংকারসহ নগদ অর্থ নিয়ে পালিয়ে যান চোর চক্রের সদস্যরা।
চুরির শেষে চক্রের সব সদস্য কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদের ভাড়া বাসায় যান। চুরি করা সোনার একটা অংশ এক ব্যক্তির কাছে ৩৬ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। সোনা বিক্রির ৩৬ লাখ টাকা, চুরি করা নগদ ৫ লাখ টাকা, বিক্রি না হওয়া সোনা ও অন্যান্য অলংকার মোট নয় ভাগে ভাগ করা হয়। দুই ভাগ দেওয়া হয় নাসিরকে। তাঁর ভাগ শামীম নিজের কাছে রাখেন। মালামাল বুঝে পাওয়ার পর যে যাঁর মতো নিজেদের গ্রামের বাড়িতে চলে যান।
আরও চুরি
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, ২০২০ সালের আগস্টে রাজধানী ডেমরার হাজি হোসেন প্লাজায় নিউ কেয়া জুয়েলার্সের ২০০ ভরি সোনা ও দেড় লাখ টাকা চুরির ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এই চুরির ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করা যাচ্ছিল না। কিন্তু রাঙাপরী জুয়েলার্সের চুরির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উদ্ঘাটন করে যে দুটি ঘটনার সঙ্গেই একই চোর চক্র জড়িত।
২০১৮ সালের মার্চে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের হাজি আহসান উল্লাহ মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় নাভী ও ক্রাউন জুয়েলার্স নামের দুটি দোকান থেকে ৩৪২ ভরি সোনা ও ১ লাখ ১৬ হাজার টাকা চুরি হয়। এই মামলায় রাজা ও মাসুদ গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় দেড় বছর কারাগারে ছিলেন। পরে তাঁরা জামিনে বেরিয়ে আবার চুরি শুরু করেন।
২০১৪ সালে জয়পুরহাট সদরের একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা চুরি হয়। দেয়াল কেটে ব্যাংকে প্রবেশ করেছিলেন চোর চক্রের সদস্যরা। তাঁরা ব্যাংকের পাশের একটি ঘরের কক্ষ ভাড়া নিয়েছিলেন। এই মিশনে ১০ জন অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে রাজা অন্যতম। এ ঘটনায় তিনি গ্রেপ্তার হয়ে তিন বছর কারাগারে ছিলেন।