বাবার মৃত্যুর পর মেয়ে খুন, দুজনকেই হত্যার অভিযোগ ছেলের বিরুদ্ধে

বোন হত্যায় গ্রেপ্তার শফিউল আযমের বিরুদ্ধে বাবাকে হত্যার অভিযোগ তুলেছেন তাঁর আরেক বোন
ছবি: সংগৃহীত

পাঁচ মাস আগে নেত্রকোনার কংস নদে অজ্ঞাতনামা এক নারীর লাশ পায় পুলিশ। পরে জানা যায়, খুন হয়েছেন তিনি। এই হত্যাকাণ্ডে কুষ্টিয়া থেকে তাঁর এক চাচাতো ভাইকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁর স্বীকারোক্তিতে উঠে এসেছে শামীমা বেগমকে খুন করিয়েছেন তাঁরই আপন ভাই। এখন ওই ভাইয়ের বিরুদ্ধে তাঁর বাবাকেও হত্যার অভিযোগ করছে পরিবার।

বোনকে হত্যায় কারাবন্দী শফিউল আযম (৫০) ঢাকার বাড্ডার বাসিন্দা। তাঁর বিরুদ্ধে জাল দলিল করে সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে চার বছর আগে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন বাবা আশরাফ উদ্দিন।

আশরাফ উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। তিনি বাংলাদেশ বিমানে চাকরি করতেন। ঢাকার বাড্ডা ও উত্তরায় চারটি বাড়ি করেছিলেন। বাড্ডায় একটি মার্কেটও ছিল তাঁর।

আশরাফ উদ্দিনের চার মেয়ে, দুই ছেলে। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তবে দ্বিতীয় স্ত্রীর কোনো সন্তান ছিল না। দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে বাড্ডায় নিজের বাড়িতে থাকতেন তিনি।

আশরাফ উদ্দিনের দুই ছেলের একজন আমেরিকাপ্রবাসী। এক মেয়েও থাকেন আমেরিকায়। অপর দুই মেয়ের একজনের বিয়ে হয়েছে কুষ্টিয়ায়। বড় মেয়ে মেরিনা আফরোজ থাকেন বাড্ডায়। সেজ মেয়ে শামীমা বেগম থাকতেন উত্তরায়।

গত ২ ফেব্রুয়ারি মারা যান আশরাফ উদ্দিন। এর ২৬ দিনের মাথায় নেত্রকোনায় খুন হন তাঁর মেয়ে শামীমা। হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই শামীমার চাচাতো ভাই শামীমকে (৪০) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাঁর স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে শফিউলকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে নেত্রকোনার কংস নদ থেকে শামীমার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ, পরে হত্যাকাণ্ডে তাঁর আপন ভাইকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ

শামীমা হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নেত্রকোনা সদর থানার পরিদর্শক সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জের ধরে শফিউল আযম তাঁর চাচাতো ভাই শামীমকে দিয়ে বোন শামীমাকে হত্যা করিয়েছেন। আসামি শামীম ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এই বক্তব্য দিয়েছেন।

বোন হত্যায় শফিউল গ্রেপ্তার হওয়ার পর বাবাকে হত্যার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় মামলা করেছেন তাঁর আরেক বোন মেরিনা আফরোজ।

এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাড্ডা থানার এসআই খন্দকার রাজীব আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, বাবা আশরাফ উদ্দিন খুনের মামলায় শফিউল আযমকে আদালতের অনুমতি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ইতিমধ্যে এই মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানোর অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ বিমানে চাকরি করা আশরাফ উদ্দিন ঢাকায় চারটি বাড়ি ও একটি মার্কেট করেছিলেন, নিজের ছেলের বিরুদ্ধে জাল দলিল করে সব সম্পত্তি দখলের অভিযোগ করেছিলেন তিনি

ছেলের বিরুদ্ধে বাবার জিডি

আশরাফ উদ্দিনের বড় মেয়ে মেরিনা আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাবা ও মায়ের সম্পত্তি জাল দলিলের মাধ্যমে নিজের নামে করে নেন বড় ভাই শফিউল আজম। বিষয়টি জানার পর বাবা বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে দক্ষিণখান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। পরে জাল দলিল বাতিল চেয়ে শফিউল আযমের বিরুদ্ধে ঢাকার দেওয়ানি আদালতে মামলাও করেন। মামলা করার পর থেকে বাবাসহ তাঁদের নানাভাবে হয়রানি ও হুমকি দিয়ে আসছিলেন ভাই শফিউল আযম।

বাবাকে তাঁর ভাই শফিউল আযম খুন করেছেন দাবি করে মেরিনা আফরোজ মামলায় বলেছেন, তাঁর বাবা সুস্থ ছিলেন। কিন্তু পরস্পর যোগসাজশে ভাই শফিউল আযমসহ অন্যরা গত ২ ফেব্রুয়ারি রাতে তাঁর বাবাকে শ্বাসরোধে কিংবা বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন। পরে ময়নাতদন্ত ছাড়াই তাঁর বাবার মরদেহ দাফন করা হয়। বাবার মৃত্যুর পর বোন শামীমাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাঁর বাবা খুনেও শফিউল আযমসহ অন্যরা জড়িত রয়েছেন।

আদালতের নির্দেশে গত ২৭ জুন বাড্ডা থানায় আশরাফ উদ্দিনকে হত্যার অভিযোগে শফিউলসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা রেকর্ড হয়।

তদন্ত কর্মকর্তা এসআই খন্দকার রাজীব আহম্মেদ বলেন, আশরাফ উদ্দিনের মৃত্যুর রহস্য জানার জন্য লাশ তুলে ময়নাতদন্তের অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়েছে।

শামীমার লাশ পড়ে ছিল নদীতে

শামীমা বেগমের আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২৪ বছর আগে শামীমার বিয়ে হয় নেত্রকোনার এক ব্যক্তির সঙ্গে। বিয়ের কিছু দিন পর তাঁদের ছাড়াছাড়ি হয়। এরপর আর বিয়ে করেননি শামীমা। ঢাকার উত্তরায় বাবার বাসায় থাকতেন তিনি।

শামীমার বড় বোন ও নেত্রকোনা সদর থানা–পুলিশের দেওয়া তথ্য বলছে, বেড়ানোর কথা বলে শামীমাকে নেত্রকোনায় নিয়ে যান চাচাতো ভাই শামীম। পরে নেত্রকোনা সদরের পূর্ব চকপাড়ার একটি হোটেলে শামীমাকে ‘শ্বাসরোধে হত্যা করে’ পালিয়ে যান শামীমসহ অজ্ঞাত কয়েকজন। পরে হোটেলের লোকজন কংস নদে লাশ ফেলে আসেন। খবর পেয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা হয়। মামলার তদন্তে শামীমের নাম উঠে আসে। পরে ৯ মার্চ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এই শামীমের কথায় শামীমা নেত্রকোনায় গিয়ে খুন হয়েছিলেন বলে পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে

নেত্রকোনার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে জমা দেওয়া পুলিশি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শামীমা বেগমের সঙ্গে তাঁর ভাই শফিউল আযমের জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। বিরোধের জের ধরে চাচাতো ভাই শামীম অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের সহায়তায় শামীমাকে হোটেলে হত্যা করে পালিয়ে যান।

শামীমাকে হত্যা করার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন শামীম। এরপর শফিউল আযমকে গ্রেপ্তার করা হয়। শামীমা হত্যা মামলায় শফিউলকে পাঁচ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।

তদন্ত কর্মকর্তা ও নেত্রকোনা সদর থানার পরিদর্শক সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে আসামি শফিউল আযম তাঁর চাচাতো ভাই শামীমের সঙ্গে পরিকল্পনা করে শামীমাকে নেত্রকোনায় নিয়ে আসেন। পরে শামীমাকে হত্যা করা হয়। তবে শফিউল আযম আদালতে দাবি করেছেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। কোনো খুনের সঙ্গে জড়িত নন।

তবে শামীমার বড় বোন মেরিনা আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্পত্তির লোভে বড় ভাই বোনকে খুন করেছেন। আমরা মনে করি, শামীমার মতো আমার বাবাকেও খুন করেছেন বড় ভাই শফিউল আযম। এ জন্য ভাইয়ের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছি।’