ভোর থেকে ভারতের সীমান্তসংলগ্ন বাংলাদেশের জমিতে ধানের চারা রোপণ করছিলেন একদল শ্রমিক। সকাল ১০টার দিকে তাঁদের স্ত্রীরা পুঁটলিতে বাঁধা খাবার নিয়ে খেতের কাছে যান। শ্রমিকেরা একে একে জমি থেকে উঠে আসেন। খেতের পাশের একটি পুকুরে হাত-মুখ ধুতে যান। তখনই রাইফেল হাতে ছুটে আসেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) একদল সদস্য। রাইফেলের নল শ্রমিকদের দিকে তাক করা। এ দৃশ্য দেখে শ্রমিক ও তাঁদের স্ত্রীরা ভয়ে তটস্থ। নজরুল ইসলাম নামের একজন শ্রমিক ভয়ে ভয়ে বিএসএফের এভাবে আসার কারণ জিজ্ঞেস করেন। আর ঠিক তখনই বিএসএফ তাঁর বুক লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন নজরুল। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর স্ত্রীর আনা খাবার পড়ে থাকে।
নজরুলের স্ত্রী পলাশী বেগমসহ একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম আলোর কাছে এই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন। তাঁরা বলেন, গতকাল সোমবার সকাল ১০টার দিকে দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার বিনাইল ইউনিয়নের চাপড়া সীমান্তের ২৯৫ মেইন পিলারের কাছে বাংলাদেশের অন্তত ৫০ গজ ভেতরে নয়াপুকুরের পাড়ে এ হামলা চালায় বিএসএফ। এ সময় সাহাজুল ইসলাম (৪০) নামের আরেকজন খেতমজুর গুলিবিদ্ধ হন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছে। এ প্রেক্ষাপটে এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করায় পরে অতিরিক্ত বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
নজরুলের (৩৪) বাড়ি চাপড়া গ্রামে। তাঁর স্ত্রী পলাশী গতকাল বেলা তিনটার দিকে নিজ বাড়িতে বিলাপ করতে করতে প্রথম আলোকে বলেন, একই গ্রামের মানিক মিয়া নামের এক ব্যক্তির জমিতে তাঁর স্বামী ধানের চারা রোপণ করছিলেন। আশপাশের খেতগুলোতে কাজ করছিলেন আরও ১০-১২ জন শ্রমিক। তাঁদের জন্য সকালের খাবার নিয়ে গেলে শ্রমিকেরা নয়াপুকুরে হাত-মুখ ধুতে যান। পুকুরের দক্ষিণ দিক থেকে বিএসএফের দুজন ও পশ্চিম দিক থেকে পাঁচজন সদস্য রাইফেল তাক করে আসতে থাকেন। এ সময় বিএসএফের সদস্যদের কাছে বাংলাদেশে আসার কারণ জানতে চান নজরুল। কোনো কথা না বলে তাঁকেই প্রথম গুলি করে বিএসএফ। গুলি তাঁর বুকে বিদ্ধ হয়। নজরুল সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
স্বামী হারিয়ে পাগলপ্রায় পলাশী মাতম করতে করতে বলেন, ‘মুই দৌড়ে গিয়ে মোর গুলিবিদ্ধ স্বামীক জড়িয়ে ধরনু। এডা (একজন) বিএসএফ আসে, মোর বুকত কষি লাথি মারল। মুক ফেলে দিল। তারপর মোর স্বামীর এক হাত ধরে এক বিএসএফ এবং আরেকটা বিএসএফ আসি তাঁর একটা পা ধরল। মোর স্বামীক ছেঁচড়ে কাঁটাতারের বেড়ার কাছত নিয়ে গেল। মুই বিএসএফের পা ধরি কান্নাকাটি করনু, তাও মোক স্বামীক থুয়ে গেল না। হারা গরিব মানুষ। ওরাই (স্বামী) কামাই করার লোক আছিল। কী দোষ আছিল মোর স্বামীটার? হামার দেশত আসে ক্যান তাঁরে গুলি করি মারি কুকুরের মতো ছেঁচড়ে নিয়ে গেল বিএসএফ? মুই বিচার চাও। তোরা মোর স্বামীটাক আনি দাও। ছৌল (সন্তান) দুইটাকে নিয়ে মুই এখন কুটে যান?’
প্রত্যক্ষদর্শী জমির মালিক মানিক মিয়া বলেন, বিএসএফ প্রায় প্রতিদিনই কাঁটাতার পার হয়ে ভারতের সীমানা পিলার বরাবর টহল দেয়। তিনি প্রথমে ধরে নেন, এটি নিয়মিত টহলের অংশ। কিন্তু হঠাৎ করে নয়াপুকুরের পাড়ে চলে এলে ভয় পেয়ে যান। এর পরে গুলির এ ঘটনা ঘটে। দৌড়ে কোনোমতে প্রাণ বাঁচান তিনি।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন খেতমজুর সাহাজুল বলেন, ‘বিএসএফের ছোড়া এডা গুলি মোরা পাওত লাগে। মুই ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে কোনোমতে পালিয়ে আস। না হলে মুক ধরি নিয়া যায়ে মারে ফেলল হয়।’
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক মো. বাবলু হোসেন বলেন, সাহাজুলের ডান পায়ের গোড়ালিতে গুলি লেগেছে। জরুরি অস্ত্রোপচার করতে হবে। কিন্তু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অবেদনবিদ নেই। তাই সাজেদুলকে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
নজরুলের নিকটাত্মীয় সামছুল ইসলাম বলেন, সকাল আটটার দিকে ২৯৫ পিলারের পাশে একটি জমিতে সার দেওয়াকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আকরাম হোসেনের সঙ্গে বিএসএফের এক সদস্যের বাগ্বিতণ্ডা হয়। এর জের ধরে ১০টার দিকে নয়াপুকুরের কাছে বিএসএফ আসে। তখন আকরামও সেখানে ছিলেন। বিএসএফের সদস্যরা হয়তো তাঁকে ধরতে এসেছিলেন। কিন্তু বিএসএফকে আসতে দেখে আকরাম পালিয়ে যান। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে বিএসএফের সদস্যরা শ্রমিকদের ওপর লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন।
তবে ইউপি সদস্য আকরাম বলেন, বিএসএফের সদস্যদের সঙ্গে তাঁর কোনো বাগ্বিতণ্ডা হয়নি।
সরেজমিনে দেখা গেছে নয়াপুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ের দুটি জায়গায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। নজরুলকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার দাগও স্পষ্ট। বেলা তিনটা পর্যন্ত ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৩৫০ গজ দূরে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে তাঁর লাশ ফেলে রাখা হয়। এরপর ভারতীয় পুলিশ লাশটি নিয়ে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজিবির এক সদস্য বলেন, নজরুলের বুকের ডান পাঁজরে একটি গুলির চিহ্ন রয়েছে। তাঁর লাশ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ায় শরীরের পেছনের অংশ ছিলে গেছে।
এ ঘটনায় বেলা আড়াইটার দিকে দিনাজপুর বিজিবির সেক্টর কমান্ডার হ্লা হেন মং এবং বিএসএফের রায়গঞ্জ সেক্টর কমান্ড্যান্ট জশওয়ান্ত সিং পতাকা বৈঠক করেন। এ সময় সেখানে বিজিবি ২৯ ব্যাটালিয়েনের অধিনায়ক লে. কর্নেল জাহিদুর রশিদ এবং বিএসএফের ৯৬ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কমান্ড্যান্ট রাজেন সুদ উপস্থিত ছিলেন।
পতাকা বৈঠক শেষে হ্লা হেন মং সাংবাদিকদের বলেন, ‘যে স্থানে হত্যাকাণ্ডটি হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। তবু বিএসএফ বরাবরের মতো এ ঘটনার জন্য বাংলাদেশিদের দায়ী করার চেষ্টা করেছে। আমরা লিখিতভাবে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছি।’ তিনি জানান, ময়নাতদন্ত শেষে আগামীকাল (আজ) মঙ্গলবার লাশ ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিএসএফ। এ ঘটনায় বিএসএফ ও বিজিবির পক্ষ থেকে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।