স্বাধীনতার পর থেকে উন্নয়নকাজের জন্য দেড় লাখ একরের বেশি বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে বন মন্ত্রণালয়। জমি পেয়েছে খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠান, দু-একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও। তিন লাখ একরের কাছাকাছি বনের জমি জবরদখল করেছেন বেসরকারি শিল্পপতি, প্রভাবশালী ব্যক্তি বা এলাকাবাসীরা।
এভাবে এ যাবৎ সাড়ে চার লাখ একর বনভূমি বন অধিদপ্তরের হাতছাড়া হয়ে গেছে। বড় বরাদ্দ নিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা), বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফআইডিসি), গ্যাসক্ষেত্র, সড়ক কর্তৃপক্ষ ও বিভিন্ন বাহিনী।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের কাছে আরও আধা লাখ একর বনভূমির চাহিদা দেওয়া আছে। বন বিভাগের অভিযোগ, গ্রহীতা সংস্থাগুলো বরাদ্দের চেয়ে বেশি জমি দখল করছে।
বেজার কাছে আছে সাড়ে নয় হাজার একরের মতো। বিএফআইডিসি বরাদ্দ নিয়েছে মোট প্রায় ২৫ হাজার একর। বিভিন্ন বাহিনীর ব্যবহারে আছে প্রায় ৯৩ হাজার একর। এসব হিসাব দিয়েছে মন্ত্রণালয়ের বনসংশ্লিষ্ট শাখা।
তবে এই হিসাবে অনেক সময় বড় বড় পরিমাণ জমি কয়েকটি করে সংস্থার নামে একত্রে দেখানো আছে। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের বসতির কারণে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ছয় হাজার একরের কিছু বেশি বনভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে। এটা আনুষ্ঠানিক বরাদ্দের বাইরে।
১৮ অক্টোবর পরিবেশ, বন ও জলবায়ুবিষয়ক সংসদীয় কমিটির কাছে বন অধিদপ্তর দখলের একটি হিসাব দিয়েছে। সেটা বলছে, জবরদখলকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯০ হাজারের মতো। দখল সবচেয়ে বেশি হয়েছে কক্সবাজারে। দখলদারেরা ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী।
মন্ত্রণালয়ের সচিব জিয়াউল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, উন্নয়নের প্রয়োজনে জমি তো বরাদ্দ দিতেই হবে। তবে বরাদ্দের সময় মন্ত্রণালয় কাজ শেষে গাছ লাগানোর শর্ত বেঁধে দেয়। তা ছাড়া, চাইলেই বরাদ্দ দেওয়া হয় না। তিনি আরও বলেন, বন কর্তৃপক্ষ জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করে। জমি উদ্ধারও হচ্ছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের বনাঞ্চল আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। পরিবেশের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে হলে একটি দেশে মোট ভূখণ্ডের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হয়। বন অধিদপ্তরের হিসাবে এখন বনভূমি আছে ১৩ শতাংশ।
প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে কাজ করে আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন। সংস্থাটির হিসাবে, পৃথিবীর ১০–১৫ শতাংশ মানুষ এখনো বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বনভূমির হার ২০ শতাংশ করতে চাইছে।
বন অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ৬৩ লাখ একরের বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৩৩ লাখ একর হচ্ছে সংরক্ষিত বন। রক্ষিত বা প্রোটেকটেড বনের পরিমাণ ১২ লাখ একরের মতো। সামাজিক বনায়নের আওতায় সৃজিত বাগান আছে দেড় লাখ একরের বেশি।
বরাদ্দ, বন্দোবস্ত
বন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে বনভূমি বন অধিদপ্তরের নামে নিবন্ধন করা নেই। অনেক সময় জেলা প্রশাসকেরা খাসজমি হিসেবে সংরক্ষিত বনের জমি প্রতীকী মূল্যে বন্দোবস্ত দিয়ে দেন।
চারজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার খুনিয়াপারং মৌজার রক্ষিত বনভূমি খাসজমি হিসেবে নিবন্ধিত। জেলা প্রশাসক একজন সাবেক প্রভাবশালী সচিবের ভাইয়ের নামে সে জমি বরাদ্দ দেন। ময়মনসিংহের ৩০টি মৌজায় বনভূমি বন অধিদপ্তরের নামে নিবন্ধিত নয়। এমন আরও অনেক উদাহরণ আছে।
অধিদপ্তর নিয়মিত ভূমি মন্ত্রণালয়কে চিঠি লিখে সমাধান চাইছে। বন মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবকে একটি চিঠি দেয়। তারা অনুরোধ করে যেন, রেললাইন, রাস্তা, ড্রেন, বিদ্যুৎ, গ্যাস সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, সীমান্তচৌকি (বিওপি) স্থাপনসহ বিভিন্ন উন্নয়নে বনভূমি ব্যবহার না করা হয়।
মন্ত্রণালয় বলে, রাষ্ট্রীয় জরুরি কোনো প্রয়োজনে বনভূমি নেওয়া হলে সমপরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করে বন সৃজনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হোক।
কক্সবাজারের মহেশখালীতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) ১৯০ একর সংরক্ষিত বনভূমি দেওয়া হয়েছে। সেখানে বন কেটে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল রাখার টার্মিনাল হবে।
মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র বলছে, দেশের একমাত্র পাহাড়ি এই দ্বীপের বনে বিভিন্ন প্রজাতির দুই হাজারের কাছাকাছি গাছসহ অনেক বনজ সম্পদ কাটার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ক্ষতি বাবদ বিপিসি সরকারকে ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা দিচ্ছে।
পেট্রোবাংলা টাঙ্গাইল জেলার সখীপুর উপজেলায় সম্প্রতি গ্যাসের পাইপলাইন বসানোর জন্য ৫৩ একর জমি বরাদ্দ নিয়েছে। এর ফলে সখীপুরের সাতটি মৌজায় প্রায় ১৮ হাজার গাছ কাটা পড়বে। এর মধ্যে প্রাকৃতিক বনের প্রায় এক হাজার গজারি গাছ রয়েছে।
গাছগুলোর মূল্য বাবদ বন অধিদপ্তর পাবে তিন কোটি টাকা। গত ৩১ আগস্ট জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বন মন্ত্রণালয়ের কাছে গাছ কাটার অনুমতি চেয়ে চিঠি দিয়েছে। এ নিয়ে এলাকায় গণবিক্ষোভও হয়েছে।
বাংলাদেশে আইইউসিএনের সাবেক প্রধান ও সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এক হাঁড়ি দুধের মধ্য এক ফোঁটা লেবুর রস পড়লে যেমন পুরোটা দুধই নষ্ট হয়ে যায়, তেমনি বনের ভেতরের জমি বরাদ্দ দিলে পুরো বনে বিপর্যয় নামে।
ইশতিয়াক বলেন, উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ দিতে হলে জেনে নিতে হবে বনের কী কী ক্ষতি হতে পারে। বনভূমি উজাড় করার পর দশ গুণ গাছ লাগানো কখনোই সম্ভব নয়। জমির সে অবস্থাই থাকে না। তাঁর মতে, ক্ষতিপূরণের বিষয়টি হাস্যকর।
বনের ক্ষতি হচ্ছে হোক!
১৯৭২ সালের বন আইন অনুযায়ী সংরক্ষিত বনের মধ্য দিয়ে রাস্তা নির্মাণ নিষিদ্ধ। কিন্তু স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বিভিন্ন এলাকায় শালবনের ক্ষতি করে অনুমোদনহীনভাবে রাস্তা ও পয়োনালা নির্মাণ করছে।
নথি বলছে, বন মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার বিভাগকে বহুবার চিঠি দিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। তিনজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, এসব চিঠি কখনো আমলে নেওয়া হয়নি।
নথিপত্রে দেখা যায়, এলজিইডি সংরক্ষিত বন উজাড় করে, পাথর ও টিলা কেটে কক্সবাজারের টেকনাফ-শাপলাপুর সড়ক নির্মাণ করেছে। বান্দরবানেও সংরক্ষিত বনের মধ্য দিয়ে সড়ক নির্মাণ করেছে এলজিইডি। বন কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে উপজেলা প্রকৌশলী ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কাজ হয়নি।
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বন ও পরিবেশবিষয়ক সংস্থা আরণ্যক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলছেন, কোনো কারণেই বনের জমি বরাদ্দ দেওয়া যাবে না। সংরক্ষিত বনের মধ্য দিয়ে রাস্তা বানানো যাবে না। বেদখল হওয়া বন উদ্ধারের জন্য কাজ করতে হবে।