শুধু নিজের এলাকায় নয়, আরও ৯ জেলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগে টেন্ডারবাজি করেছেন ফরিদপুরের দুই ভাই বরকত ও রুবেল। গ্রেপ্তারের পর ঢাকায় সিআইডি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তাঁরা এসব জানিয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, জবানবন্দিতে তাঁরা আরও অনেক সহযোগীর নাম বলেছেন। তাঁদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
ফরিদপুর জেলা পুলিশের সূত্র জানায়, সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে ঈদের আগের দিন ও ঈদের দিন মিলে তিনজনকে নিজ নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম খন্দকার ওরফে লেবি, শহর যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসিবুর রহমান ওরফে ফারহান এবং জেলা শ্রমিক লীগের কোষাধ্যক্ষ বিল্লাল হোসেন। গ্রেপ্তারের পর তিনজনকেই কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এর আগে ৭ জুন গ্রেপ্তার হন ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে বরকত ও তাঁর ভাই ইমতিয়াজ হাসান ওরফে রুবেল। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় সন্ত্রাস, জমি দখল, টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্ম করে বেড়াতেন তাঁরা।
ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেছেন, সর্বশেষ গ্রেপ্তার করা তিনজনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা রয়েছে। তাঁদের ঢাকায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ফরিদপুর শহরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনায় এ নিয়ে প্রায় দুই মাসে ১৬ জন গ্রেপ্তার হলেন।
সিআইডি পুলিশের একটি সূত্র জানায়, দুই ভাই ফরিদপুরের বাইরে খুলনা, গোপালগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মাগুরা, পটুয়াখালী, শেরপুর, সিলেট, গাজীপুর ও দিনাজপুরে ঠিকাদারি কাজ করেছেন। এসব কাজের ক্ষেত্রেও তাঁরা অন্য ঠিকাদারদের দরপত্র জমা দিতে দেননি। কেউ জমা দেওয়ার চেষ্টা করলে মারধর করে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে পাঠিয়েছেন।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুর রশীদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিজেও আগে এসব অনিয়মের কথা শুনতাম। কিন্তু কীভাবে হয়েছে, সেটা জানি না। কারণ, আমি কিছুদিন আগে এ পদে এসেছি। এখন সাধ্যমতো দেখার চেষ্টা করছি। কোনো অনিয়ম থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’
এমন একটি ঘটনার শিকার ফরিদপুর-১ আসনের প্রয়াত সাংসদ দেলোয়ার হোসেনের ছেলে তাওফিক হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ২০১৮ সালে ৬৫ লাখ টাকার কাজের জন্য দরপত্র কিনেছিলেন তিনি। এই অপরাধে হেলমেট বাহিনী তাঁর ওপর হামলা চালায়। তাদের মারধরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। জ্ঞান ফিরে দেখেন, তিনি পুলিশি পাহারায় হাজতে। একটি হত্যা মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়েছে। এরপর তিন মাস জেল খেটে বেরিয়ে আসেন।
সিআইডি জানায়, বড় কাজের ক্ষেত্রে তাঁরা অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে জোর করে লাইসেন্স নিয়ে ব্যবহার করতেন। এ রকম দুটি বড় কাজে বরকত-রুবেলরা ফরিদপুরের করিম গ্রুপের লাইসেন্স ব্যবহার করেছেন।
জানতে চাইলে করিম গ্রুপের পরিচালক ওয়াহেদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা গোপালগঞ্জের ১৪৫ কোটি টাকার দুটি কাজে করিম গ্রুপের লাইসেন্স ব্যবহার করেছিলেন। এর বিনিময়ে গ্রুপ কোনো আর্থিক সুবিধা পায়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা এটা দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।’
গ্রেপ্তার হলেন আরও তিনজন
ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম খন্দকার ওরফে লেবিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ঈদের আগের দিন দুপুরে তাঁর চর কমলাপুরের ব্যক্তিগত কার্যালয় থেকে। পৌরসভা, পাসপোর্ট অফিস, বিআরটিএ ও শহরের ফুটপাতে তিনি চাঁদাবাজি করতেন। বরকত আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, নাজমুলের পক্ষে নাসির নামের এক যুবলীগ নেতা চাঁদাবাজি করতেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন বলেন, ২০০৯ সালে খন্দকার মোশাররফ হোসেন মন্ত্রী হওয়ার পর নাজমুল ক্ষমতার কেন্দ্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ২০১৭ সালের পর থেকে বরকত, রুবেলদের মতো নাজমুলও কেউকেটা হয়ে ওঠেন। শিক্ষাজীবনে স্কুলের গণ্ডি অতিক্রম করতে না পারলেও রাজনীতিতে তরতর করে ওপরে ওঠেন। প্রথমে ছিলেন ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি। এরপর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং পরে শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি হন।
অভিযোগ আছে, জমি কেনা থেকে বাড়ি করা পর্যন্ত নাজমুলকে নজরানা দিতে হতো। সব উন্নয়নকাজের বখরা নিতেন তিনি। দ্রুতই বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে ওঠেন। শহরের মৈত্রী টাওয়ারে তাঁর রয়েছে তিনটি ফ্ল্যাট। খান টাওয়ারে নিজের নামে দুটি (৮ ও ৯ তলায়) ও ভাইয়ের মেয়ের নামে দুটি ফ্ল্যাট কেনেন। বিল মাহমুদপুর স্লুইসগেটের কাছে কিনেছেন ৬০ শতাংশ জমি। ঢাকায় আছে আরও তিনটি ফ্ল্যাট।
ঈদের দিনে গ্রেপ্তার হওয়া আরেকজন হলেন বিল্লাল হোসেন। সাংসদ মোশাররফ হোসেনের ভাই মোহতেসাম হোসেন ওরফে বাবরের ব্যক্তিগত কর্মচারী ছিলেন বিল্লাল। শুধু কর্মচারী হলেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। তিনিও স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেননি।
শহরের লোকজন জানান, ২০০৮ সালের আগে মুলি বাঁশের বেড়া ও টিনের ঘরে বাস করতেন বিল্লাল। বাবরের মালিকানাধীন রাজ পোলট্রি ফার্মে চা-নাশতা আনার কাজ করতেন। পরে বাবরের আশীর্বাদে তিনি জেলা শ্রমিক লীগের অলিখিত অর্থ সম্পাদক হয়ে বসেন।
ফরিদপুর শহরতলির হাড়োকান্দি এলাকার এক বাসিন্দা জানান, আদালতের মালি শেখ ইসামুদ্দিনের চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বিল্লাল বড়। সেই বিল্লাল নিজের বাড়ি করতে বিদেশ থেকে টাইলস নিয়ে আসেন।
ফরিদপুর সদরের কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের পাচ্চর এলাকায় ১২০ বিঘা জমির ওপর একটি ইটভাটা আছে তাঁর। এই ভাটা দেখাশোনা করেন বিল্লালের ভায়রা বাবলু। চণ্ডীপুরে আরও একটি ইটভাটা ২৫ বিঘা জমির ওপর। এই ২৫ বিঘার মধ্যে ১০ বিঘা আছে খাসজমি। সেই জমি দখল করে তিনি ইটভাটা করেন। মুন্সিবাজার বাইপাস সড়কের পাশে তাঁর আড়াই একর জমি আছে। আর ভাটপাড়ার চকে রয়েছে ৩০ বিঘা জমি। এ ছাড়া হাবেলি রাজাপুর ও কৈজুরি মৌজায় দোপচক ও ভাঙ্গাচকে ১৫ বিঘা জমি রয়েছে বিল্লালের।
ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ফরিদপুর সদরের আজিজ পাইপের পাশে একটি পেট্রলপাম্প করার জন্য দেড় একর জায়গা কিনেছেন বিল্লাল, যদিও পেট্রলপাম্পটি এখনো হয়নি। অয়ন ডিলাক্স নামের একটি মিনিবাসের মালিকও তিনি। তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি তিনটি।
ফরিদপুর জেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক শহীদ হোসেন জানান, বিল্লাল জেলা শ্রমিক লীগের কোষাধ্যক্ষ কখনোই ছিলেন না। তারপরও নিজেকে শ্রমিক লীগের কোষাধ্যক্ষ ও কোতোয়ালি আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে পরিচয় দিতেন।
শুধু স্লোগান দিয়েই নেতা
ফরিদপুর সদর আসনের সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন শহরসহ আশপাশের যে জায়গায় সভা-সমাবেশ করতেন, সেখানেই স্লোগান দিতেন আসিবুর রহমান ওরফে ফারহান। সেই পরিচয়ে শহর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হন।
ফারহানের বাবা শওকত মো. কামাল জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক ছিলেন। তাঁর মা মমতাজ বেগম জেলা জামায়াতে ইসলামীর সক্রিয় সদস্য। সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে পড়াশোনার সুবাদে আসিবুর কলেজের ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এটা করতে গিয়ে একটি বাহিনীও গড়ে তোলেন। এই বাহিনীর সদস্যরা ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপকর্ম করতেন।
পুলিশ জানায়, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলী এলাকায় সোনালী ব্যাংকের কাছে একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় মারা যান ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক নার্স। এ ঘটনার সঙ্গে ফারহান বাহিনীর জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশিত হলে তিনি আত্মগোপন করেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, আসিবুরের নামে ঢাকার মিরপুরে এক ভবনেই চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া ফরিদপুর শহরতলির বিল মাহমুদপুর এলাকায় দুই স্থানে ১০৪ শতাংশ ও ৬৫ শতাংশ জমি রয়েছে। শহরের হিতৈষী স্কুলের সামনে ‘রেইন ফরেস্ট’ নামের একটি চায়নিজ রেস্তোরাঁ রয়েছে। ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার দক্ষিণে পৌরসভার জায়গা ইজারা নিয়ে দোতলা বাড়ি করেছেন তিনি।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফরিদপুরে এত দিন অন্যায় শাসন চলে আসছিল। আমরা বরাবরই তার প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু কাজ হয়নি। ফরিদপুরের দুরবস্থার কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, তাতে এখানকার রাজনীতি কলুষমুক্ত হয়েছে। ভালো মানুষের রাজনীতির পথ উন্মুক্ত হয়েছে।’
পেছনের কথা
সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও তাঁর ভাই মোহতেসাম হোসেন বাবরের হাত ধরে রাজনীতিতে আসা রুবেল ও বরকত রাতারাতি ফরিদপুরের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন। তাঁরা সেখানে দুটি বাহিনী গড়ে তোলেন। এরপর একের পর এক বিভিন্ন সরকারি সংস্থা দখল করে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও জমি দখল করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। তাঁরা যাকে খুশি তুলে এনে মারধর ও লাঞ্ছিত করতেন। তাঁদের আক্রমণের শিকার অনেকে শহর থেকে পালিয়ে অন্যত্র চলে যান। সর্বশেষ গত ১৬ মে রুবেল-বরকতের নির্দেশে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আইনজীবী সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলা হয়। এই হামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, হামলার নির্দেশ দিয়েছেন রুবেল ও বরকত। এরপর সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে সেখানে বিশেষ অভিযান শুরু করে পুলিশ।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। আর পুলিশকে এমনভাবে তদন্ত শেষ করতে হবে, যাতে দোষীদের সাজা নিশ্চিত হয়। এই দায়িত্ব পুলিশের। তদন্তে কোনো ফাঁকফোকর থাকলে অপরাধীরা ছাড়া পাবে, তখন বিপদে পড়বে সাধারণ মানুষ।
আরও পড়ুন:
সন্ত্রাসীদের হাতে রাজনীতির ‘চেরাগ’