টেকনাফ থানার বহুল আলোচিত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ কথিত বন্দুকযুদ্ধের জন্য ২০১৯ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ পদক ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক’ বা বিপিএম পেয়েছিলেন। পদক পাওয়ার জন্য তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে ছয়টি কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের কথা উল্লেখ করেন। সব কটি ঘটনাতেই আসামি নিহত হন।
প্রদীপ কুমার দাশ প্রায় ২৫ বছরের চাকরিজীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন চট্টগ্রাম অঞ্চলে। বছর দুয়েক আগে টেকনাফ থানায় যোগ দেন। এই দুই বছরে দেড় শতাধিক ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ঘটেছে এ থানা এলাকায়। সর্বশেষ ভিডিও বার্তায় তিনি চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে টেকনাফকে মাদকমুক্ত করতে মাদক ব্যবসায়ীদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলার হুমকি দিয়ে আলোচনায় আসেন। মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার আসামি হওয়ার পর গতকাল তাঁকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
প্রদীপ কুমার দাশ বিপিএম পাওয়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যে ছয়টি ঘটনার উল্লেখ করেছেন, তার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় দুর্ধর্ষ অ্যাকশন সিনেমার। অ্যাকশন সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ডাকাত, সন্ত্রাসী, ইয়াবা কারবারি, মাদক, অস্ত্র, গোলাগুলি—সবই আছে এগুলোয়। তাঁর সম্পর্কে পুলিশ সদর দপ্তরের বাছাই কমিটির মন্তব্য ছিল, নিরস্ত্র পুলিশ পরিদর্শক প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে বহুল আলোচিত ইয়াবার কেন্দ্রবিন্দু টেকনাফ থানা এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ অস্ত্রশস্ত্রসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অস্ত্র, গুলিসহ গ্রেপ্তার ও বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করেন।
আলোচিত এই ওসি যে কৃতিত্বপূর্ণ অভিযানগুলোর কথা বলেছেন, সেগুলো ঘটে ২০১৮ সালের ২৪ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে। অভিযানের প্রথমটি হয় ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর। প্রদীপ কুমারের ভাষ্য ছিল, টেকনাফ থানার সাবরাং ইউপির কাটাবনিয়া সাকিনে ঝাউবাগানে অভিযানে গেলে অস্ত্রধারী মাদক ব্যবসায়ীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি ছোড়ে। এতে উত্তর জালিয়াপাড়া এলাকার হাসান আলী (৩৫) ও নাজিরপাড়া এলাকার মো. হোসেন প্রকাশ কামাল (২৮) গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।
দ্বিতীয়টি ২৪ অক্টোবর। ঘটনাস্থল ছিল মহেশখালিয়া পাড়ার হ্যাচারিজোন এলাকায় জঙ্গল। ইয়াবা কারবারি মফিজ আলমকে পুলিশ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় অস্ত্রসহ আটক করে। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এরপরের অভিযান একই বছরের ১৮ নভেম্বর। এর বর্ণনা দিতে গিয়ে ওসি প্রদীপ লেখেন, দক্ষিণ লেঙ্গুর বিলের ফরিদ আলমকে নিয়ে তাঁর সহযোগী ভুলু মাঝির বাড়িতে উপস্থিত হলে অস্ত্রধারী ইয়াবা ব্যবসায়ীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। সন্ত্রাসীদের গুলিতে ইয়াবা ব্যবসায়ী মো. ফরিদ আলম গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
আরেকটি ঘটনায় ওসি প্রদীপ লেখেন, ২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর ‘ইয়াবা ব্যবসায়ী’ হাবিব উল্লাহ ওরফে হাবিবকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক করে পুলিশ। হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। হাবিবের মৃত্যুর পর কক্সবাজার আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সারোয়ার কাবেরী ফেসবুকে একটি ভিডিও দেন। ওই ভিডিওতে হাবিবের স্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, বাসা থেকে তাঁর স্বামীকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বিচার চান। গতকালও নাজনীন তাঁর ফেসবুকে ওসি প্রদীপের অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদের ব্যাপারে তদন্ত দাবি করেন।
গত বছরের ২৮ আগস্ট ‘টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধ, হয়রানি, ভাঙচুর আর গুমের নেপথ্যে’ শিরোনামে প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ২৯ আগস্ট প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ মডেল থানায় সভা ডাকেন। সেখানে তিনি ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ পক্ষে বক্তব্য দেন। সেই সভার একটি ভিডিওতে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘এখানে কোনো সাংবাদিক বলতে পারে নাই আমাদের কাজের মধ্যে অন্যায় রয়ে গেছে, যেখানে আমরা ক্রসফায়ার দিয়েছি...।’ ক্রসফায়ারের প্রক্রিয়া কীভাবে চূড়ান্ত হয়, সে সম্পর্কে বলেন, বিভিন্ন আসামির নাম, বাবার নাম দিলে তিনি স্থানীয় ‘গণ্যমান্য’ ব্যক্তি, চৌকিদার, দফাদারদের শরণাপন্ন হন। গোয়েন্দা তথ্যে যদি পুলিশ মনে করে ওই ব্যক্তি কখনই ইয়াবার কারবার ছাড়বে না, তখন পুলিশ ‘ব্যবস্থা’ গ্রহণ করে।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে বন্দুকযুদ্ধের নামে যে হত্যাকাণ্ড চলছে, সেটি বন্ধ হচ্ছে না এবং তা বন্ধে যে দৃশ্যমান পদক্ষেপ দরকার, সেটাও অনুপস্থিত। উল্টো রাষ্ট্রে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার একধরনের সংস্কৃতি বহমান। আমরা দেখেছি বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে কোট–আনকোট শুটার শব্দ ব্যবহার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে পদক দেওয়ার ক্ষেত্রে জনমনে যে বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন আছে, সে বিষয়ে পারঙ্গম ব্যক্তিদের পুরস্কৃত করা হয়।’
আরও পড়ুন:
টেকনাফের ওসি প্রত্যাহার