ফারমার্স ব্যাংক থেকে (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) জালিয়াতির মাধ্যমে ১১৪ কোটি ৩৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীসহ ৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। ব্যাংকটিতে জালিয়াতির ঘটনায় এটি ৬ নম্বর মামলা।
মামলার তথ্য প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনা অনুসন্ধানে গঠিত দলের প্রধান ও দুদকের উপপরিচালক সামছুল আলম আজ বৃহস্পতিবার সংস্থার ঢাকা–১ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি করেন।
মামলার আসামিরা হলেন ফারমার্স ব্যাংকের নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী, তাঁর ভাই মাজেদুল হক ওরফে শামীম চিশতী, ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম এম শামীম, শাবাবা অ্যাপারেলসের মালিক মো. আবদুল ওয়াদুদ ওরফে কামরুল, এডিএম ডাইং অ্যান্ড ওয়াশিংয়ের মালিক রাশেদ আলী, তনুজ করপোরেশনের মালিক মো. মেফতাহ ফেরদৌস, মোহাম্মদ আলী ট্রান্সপোর্টের মালিক মো. গোলাম সারোয়ার ও ক্যানাম প্রোডাক্টসের মালিক ইসমাইল হাওলাদার।
এজাহারে বলা হয়, আসামিরা ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ৮৮ কোটি ১৬ লাখ ১৭ হাজার টাকা তুলে নিয়ে আত্মসাৎ ও পাচার করেছেন। সুদসহ ওই টাকা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১১৪ কোটি ৩৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। তাই আসামিদের বিরুদ্ধে ওই পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
এজাহারে আরও বলা হয়, মাহবুবুল হক চিশতীর ভাই মাজেদুল হক চিশতী তাঁর কর্মচারী আবদুল ওয়াদুদকে মালিক সাজিয়ে শাবাবা অ্যাপারেলস নামের একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। প্রতিষ্ঠানটি ফারমার্স ব্যাংক থেকে ১৫ কোটি ২৬ লাখ ৭৭ হাজার টাকা ফান্ডেড ঋণ সুবিধ নেয়। এ ছাড়া ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় নন ফান্ডেড ১৫ কোটি টাকা সুবিধার পরিবর্তে ৩৯ কোটি ৯ লাখ ৬ হাজার টাকার ঋণসুবিধা দেওয়া হয়, যা সুদাসলে ৪৫ কোটি ৫ লাখ ৫১ হাজার টাকায় দাঁড়ায়। এ বিষয়ে ব্যাংকটির সাবেক এমডি কোনো ব্যবস্থা নেননি। ব্যাংকের প্রভাবশালী পরিচালক মাহবুবুল হক চিশতী তাঁর ভাইয়ের মাধ্যমে নিজেই সুবিধভোগী ছিলেন।
একইভাবে মাজেদুল হক চিশতী আরেক কর্মচারী রাশেদ আলীকে মালিক সাজিয়ে এডিএম ডাইং নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। এর মাধ্যমে ১৭ কোটি টাকা ঋণসুবিধার পরিবর্তে ৫৫ কোটি ৫ লাখ ১১ হাজার টাকা ঋণ নেন।
মাজেদুল হক চিশতীর কাছে ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাগাদা দিলে তিনি পরিশোধের অঙ্গীকার করলেও পরে করেননি। অনুসন্ধান প্রতিবেদন বলছে, মাহবুবুল হক চিশতী অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকিং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজের ভাইকে অর্থ আত্মসাতে সহায়তা করেছেন। এ ছাড়া ব্যাংকটির এমডি অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ আত্মসাতে সহায়তা করেছেন।
চিশতী পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দ
সম্প্রতি মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীর স্ত্রী ও ছেলের পাঁচটি ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে দুদক। গত ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ ইমরুল কায়েশ এ–সংক্রান্ত আদেশ দেন।
আদেশে বলা হয়, দুদকের উপপরিচালক সামছুল আলম আদালতে এ–সংক্রান্ত আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়, ফারমার্স ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ব্যাংকিং নিয়ম লঙ্ঘন করে জাল–জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ ও নামে–বেনামে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে। সংশ্লিষ্ট হিসাবগুলোতে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব হিসাব থেকে টাকা বেরিয়ে গেলে অনুসন্ধানকাজ ব্যাহত হবে। তাই এসব হিসাব ফ্রিজ করা জরুরি। দুদক কর্মকর্তার আবেদনের ওপর ভিত্তি করে আদালত মোট ৬টি হিসাব ফ্রিজ করার আদেশ দেন।
জব্দ হওয়া হিসাবের মধ্যে মাহবুবুল হক চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতীর পরিচালনায় চারটি, একটি রাশেদুল হক চিশতী ও তাঁর মা রোজী চিশতী পরিচালনা করেন। আরেকটি হিসাব বকশীগঞ্জ জুট স্পিনার্সের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) সাইফুল ইসলাম মাতব্বরের। রাশেদুল হক চিশতীর পরিচালনায় যে চারটি হিসাব জব্দ করা হয়েছে সেগুলো হলো মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের বনানী শাখায় আরসিএল প্লাস্টিকস, স্টান্ডার্ড ব্যাংকের বকশীগঞ্জ শাখায় বকশীগঞ্জ জুট স্পিনার্স, ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের পল্লবী শাখায় আরসিএল প্লাস্টিকস ও যমুনা ব্যাংকের গুলশান শাখায় ফিউশন ফুটওয়্যারসের। যমুনা ব্যাংকের মহাখালী শাখায় বকশীগঞ্জ জুট স্পিনার্সের জব্দ হওয়া হিসাব পরিচালনা করেন রোজী চিশতী ও রাশেদুল হক চিশতি। সাইফুল ইসলাম মাতব্বরের জব্দ হওয়া ব্যাংক হিসাব স্টান্ডার্ড ব্যাংকের বকশীগঞ্জ শাখায়।
প্রথম মামলায় অভিযোগপত্র
দুদক বলছে, ফারমার্স ব্যাংকের জালিয়াতির ঘটনা ২০১৭ সাল থেকে অনুসন্ধান চলছে। এর আগে পাঁচটি মামলাও হয়েছে। ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল করা মামলায় অভিযোগপত্রও দিয়েছে সংস্থাটি। মাহবুবুল হক চিশতীসহ পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে অভিযোগপত্রে। চিশতী ছাড়া যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে তাঁরা হলেন মাহবুবুল হক চিশতীর স্ত্রী রুজী চিশতী, ছেলে রাশেদুল হক চিশতী, ফারমার্স ব্যাংকের চাকরিচ্যুত এসভিপি জিয়া উদ্দিন আহমেদ ও চাকরিচ্যুত ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মাসুদুর রহমান খান।
ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনাটি ২০১৭ সাল থেকে অনুসন্ধান করছে দুদক। দুদকের অনুসন্ধানে নথিপত্রের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনও পর্যালোচনা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রাহকের ঋণের ভাগ নিয়েছেন ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও মাহবুবুল হক চিশতী। এর মাধ্যমে দুজনের নৈতিক স্খলন ঘটেছে এবং তাঁরা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।
২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ফারমার্স ব্যাংক যাত্রা শুরুর পরই অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। আস্থার সংকটে আমানতকারীদের অর্থ তোলার চাপ বাড়ে। পরিস্থিতির অবনতি হলে পদ ছাড়তে বাধ্য হন মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও মাহবুবুল হক চিশতী।