ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগের দিন ‘অস্বাভাবিক আচরণ’ করছিলেন তিনি। তখন ফাঁসি স্থগিত করে পরদিনই রাষ্ট্রপতির কাছে তড়িঘড়ি প্রাণভিক্ষা চাওয়া হয়। তিন মাস পর মানসিকভাবে অসুস্থ বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি তাঁর সাজা কমিয়ে দেন। কিন্তু কারাগার থেকে বেরোনোর পর ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আসলাম ফকিরের আচরণে অসুস্থতার ছিটেফোঁটাও নেই। এখন তিনি ব্যস্ত রাজনৈতিক গণসংযোগে।
‘আরে আপা, অসুস্থ ছিলাম না কারাগরে। ফাঁসির দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যাওয়ায় কিছুটা ভয় পেয়ে গেছিলাম। পরদিন দেখি, ফাঁসি বাতিল হয়ে গেছে।’
ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক সাংসদ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ ও তাঁর স্ত্রী সাংসদ নিলুফার জাফরউল্যাহর সঙ্গে এলাকার নানা কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছে আসলাম ফকিরকে। তাঁর সাজা মওকুফের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে এ দুজন ভূমিকা রেখেছিলেন বলে কথিত আছে। অন্যদিকে আসলামের নিজেরও ইচ্ছা এখন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করার এবং আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার।
‘আপনি কারাগারে থাকাকালে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, এ জন্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যায়নি। কী সমস্যা হয়েছিল?’ গত বুধবার টেলিফোনে এ প্রশ্ন করা হলে আসলাম ফকির এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আরে আপা, অসুস্থ ছিলাম না কারাগরে। ফাঁসির দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যাওয়ায় কিছুটা ভয় পেয়ে গেছিলাম। পরদিন দেখি, ফাঁসি বাতিল হয়ে গেছে।’
আপনাকে সাজা মওকুফ পেতে কারা সহায়তা করল? জানতে চাইলে আসলাম ফকির বলেন, ‘কে আর করবে? লিডার কাজী জাফরউল্যাহ ও তাঁর স্ত্রী সাংসদ নিলুফার জাফরউল্যাহ। তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁরা কী পারেন।’
ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার মানিকদহ ইউনিয়নের আসলাম ফকির ২০০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর একই ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম সাহেদ আলী ওরফে সাহেব আলী মিয়াকে হত্যা করেন। দুজনই ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে আসছিলেন পর্যায়ক্রমে। জেলা ও দায়রা জজ আদালত আসলাম ফকিরকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। পরে হাইকোর্ট এ রায় বহাল রাখেন।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ১৯ মে খুনের দোষ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন আসলাম ফকির। কিন্তু ২০১৪ সালের ১৩ অক্টোবর তা নামঞ্জুর হয়। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দিন ধার্য হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার জন্য চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু ১২ নভেম্বর বন্দী আসলাম ফকির এমন আচরণ শুরু করেন, কারাগারের নথির ভাষায় যেটা ছিল ‘অস্বাভাবিক’ বা ‘অসুস্থতা’। এর ফলে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত করা হয় এবং ওই দিনই দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করা হয়।
দ্বিতীয় দফায় প্রাণভিক্ষার আবেদন গৃহীত হলে আসলামের দণ্ড হ্রাস করা হয় ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। তাঁকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিশেষ দিবসে বন্দীদের সাধারণ ক্ষমা লাভের সুযোগ নিয়ে গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনানুষ্ঠানিক চিঠি (ডিও লেটার) দেন সাংসদ নিলুফার জাফরউল্যাহ।
১৩ বছর ২ দিন কারাভোগের পর গত ২৫ আগস্ট গাজীপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে মুক্তি পান আসলাম। তিন দিন পর ২৮ আগস্ট তিনি ফিরে আসেন মানিকদহ গ্রামে। এরপর থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নিয়ে। গত বৃহস্পতিবার রাতেও টেলিফোনে কথা হয় আসলামের সঙ্গে। শারীরিক ও মানসিক অবস্থা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, তিনি পুরোপুরি সুস্থ আছেন। অনেকগুলো হাসপাতালে চেকআপ করিয়েছেন, কোনো সমস্যা নেই। এখন ব্যস্ত গণসংযোগ নিয়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, আসলামের বাড়িতে দর্শনার্থীর ভিড় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। তিনি যখন বাইরে বের হন, তাঁর সঙ্গে থাকে মোটরসাইকেলের বহর। ১৭ সেপ্টেম্বরও কাজী জাফরউল্যাহর সঙ্গে সদরপুর ও চরভদ্রাসনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেন আসলাম ফকির।
এ বিষয়ে টেলিফোনে কাজী জাফরউল্যাহর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি রাজনৈতিক। তিনি এর বেশি কিছু মন্তব্য করবেন না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে তো মানসিক রোগী ছিল। এ জন্যই তাকে ক্ষমা করা হয়েছে। এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে, গণসংযোগ করছে, কী বলেন? খোঁজ নিতে হবে তো। এটা মেনে নেওয়া যায় না।’
নিহত ইউপি চেয়ারম্যানের স্ত্রী ও মামলার বাদী পারুল আক্তারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এত বড় অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না। ফাঁসির দিন ধার্য করে পরিপত্র জারি হয়। পরে অসুস্থ সেজে ফাঁসি স্থগিত করছে। প্রভাবশালীরা আমার স্বামীর খুনিকে রেহাই দিয়ে উৎসব করছে। আর ওই খুনি এলাকায় এসে গণসংযোগ করছে।’
আইনজীবী শাহদীন মালিক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনাক্রম শুনে মনে হচ্ছে, আমরা খুব অসুস্থ অবস্থার মধ্যে আছি। প্রশাসনের নানা পর্যায়ে ক্ষমতাধরদের অসুস্থ মানসিকতার অবস্থা পরিষ্কার। কাকে ক্ষমা করা যাবে বা কার সাজা মওকুফ করা যাবে, সে ব্যাপারে কোনো নীতিমালা নেই। অন্যান্য দেশে এ বিষয়টি স্পষ্ট করা থাকে। নীতিমালা না থাকায় ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছে।’