চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা

প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রে জনপ্রতিনিধিও

প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরিন গ্রেপ্তার।

মাহবুবা নাসরিন
ছবি: সংগৃহীত

ভর্তি পরীক্ষা ও সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিভিন্ন ঘটনায় এর আগে পুলিশের তদন্তে বেশ কয়েকজন শিক্ষক, ব্যাংক কর্মকর্তা ও ছাত্রলীগের নেতার নাম এসেছিল। এবার জানা গেল, নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জনপ্রতিনিধিও জড়িত। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) তথ্য বলছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের একটি চক্রে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা পরিষদের বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরিন জড়িত।

মাহবুবাকে গত শুক্রবার ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের অধীন ‘অডিটর’ নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।

ডিবি বলছে, মাহবুবার সঙ্গে মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের (সিজিএ) বরখাস্তকৃত কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসানও রয়েছেন। এই চক্রের মোট ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীও রয়েছেন।

ডিবি সূত্র বলছে, মূলত পরীক্ষার্থী হিসেবে কেন্দ্রে হাজির থেকে ‘ডিজিটাল ডিভাইস’ ব্যবহার করে টাকা নেওয়া চাকরিপ্রার্থীদের প্রশ্নের উত্তর লিখতে মাহবুবা নাসরিন সহায়তা করতেন। রাজনীতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তিনি নানা অপরাধে জড়িয়েছেন।

মাহবুবা ইডেন কলেজে পড়ার সময় ছাত্রলীগের দাপুটে নেত্রী ছিলেন। প্রথমে কলেজ ছাত্রলীগের ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। পরে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্বও পালন করেন। ২০১৭ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি (মাস্টার্স) অর্জনের পর বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় নিজ এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর ২০১৯ সালের মার্চে দুপচাঁচিয়া উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

উল্লেখ্য, গত শুক্রবার বিকেলে ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে ‘অডিটর’ নিয়োগের পরীক্ষা হয়। এই পরীক্ষায় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবাও অংশ নেন বলে ডিবি জানিয়েছে। তাঁকে পরীক্ষার কেন্দ্র থেকেই বিশেষ ধরনের ডিভাইসসহ (প্রশ্নপত্র ফাঁসের কাজে ব্যবহার করা হয়) গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান ডিবির উপকমিশনার মশিউর রহমান।

ডিবি সূত্র বলছে, মূলত পরীক্ষার্থী হিসেবে কেন্দ্রে হাজির থেকে ‘ডিজিটাল ডিভাইস’ ব্যবহার করে টাকা নেওয়া চাকরিপ্রার্থীদের প্রশ্নের উত্তর লিখতে মাহবুবা নাসরিন সহায়তা করতেন। রাজনীতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তিনি নানা অপরাধে জড়িয়েছেন। এর আগে রেলওয়েসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস জালিয়াতিতে তাঁর জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতি করার সময় হলের সিট-বাণিজ্য ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করারও অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

মাহবুবা ইডেন কলেজে পড়ার সময় ছাত্রলীগের দাপুটে নেত্রী ছিলেন। প্রথমে কলেজ ছাত্রলীগের ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। পরে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্বও পালন করেন। ২০১৭ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি (মাস্টার্স) অর্জনের পর বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় নিজ এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর ২০১৯ সালের মার্চে দুপচাঁচিয়া উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

এদিকে মাহবুবাসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল শনিবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যরা চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে এমসিকিউ, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার কথা বলে ১৬ লাখ টাকা চুক্তি করতেন। দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা অগ্রিম হিসেবে নেওয়া হতো।

এর আগে গত বছরের নভেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান নিখিল রঞ্জন ধরের নাম আসে পুলিশের তদন্তে। এরপর বুয়েট কর্তৃপক্ষ তাঁকে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়। পাশাপাশি তাঁকে কোনো পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন না করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের আরেকটি ঘটনায় বরখাস্ত হওয়া দুই ব্যাংক কর্মকর্তা ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক এক কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাবে গত বছর ছয় কোটি টাকা পায় সিআইডি। আর ভর্তি পরীক্ষার

(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ছাত্রলীগের ২১ নেতা-কর্মীসহ ১২৫ জনের বিচার গত বছর শুরু হয়েছে।

‘অডিটর’ নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস

ডিবি সূত্র জানায়, প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে ৫৫০টি অডিটর পদে নিয়োগের জন্য ৭০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা হয় গত শুক্রবার। অসদুপায় অবলম্বন করে কিছু চাকরিপ্রার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছেন, এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে প্রথমে কাকরাইলের একটি আবাসিক হোটেল থেকে গত শুক্রবার বিকেলে দুই পরীক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার বিজি প্রেস উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র ও কাফরুলের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে চক্রের দুই মূল হোতা মাহবুবা নাসরিন, মাহমুদুল হাসানসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে পাঁচটি ব্যাংকের চেক, সাতটি নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, ১০টি স্মার্টফোন, ১৮টি প্রবেশপত্র, নগদ ২ লাখ টাকা এবং ফাঁস হওয়া তিন সেট প্রশ্নপত্র জব্দ করা হয়।

ডিবির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কীভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়েছে, সেটা মহাহিসাব নিরীক্ষকের মহাপরিচালকে অবহিত করা হয়েছে। পরীক্ষা বাতিল করা বা পুনরায় পরীক্ষা নেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে।

দুই মিনিটে ফাঁস হতো প্রশ্ন

ডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, পরীক্ষাকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ‘ডিভাইস’ (একধরনের যন্ত্র) নিয়ে হলে প্রবেশ করেন চাকরিপ্রার্থী এবং চক্রের সদস্যরা। পরীক্ষার্থীদের উপস্থিতি ও স্বাক্ষর গ্রহণকালে ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্নের ছবি তুলে দ্রুত তা বাইরে পাঠিয়ে দেন চক্রের সদস্যরা। এই কাজ করতে চক্রের সদস্যরা মাত্র দুই মিনিট সময় নেন। বাইরে থেকে প্রশ্নের সমাধান করে পরীক্ষার্থীদের ডিভাইসে উত্তর পাঠান চক্রের অন্য সদস্যরা। সেই উত্তর দেখে পরীক্ষা দেন চাকরিপ্রার্থীরা।

ডিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষাকেন্দ্রে যাঁরা দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের অবহেলার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। অথবা কেউ কেউ সচেতনভাবে চক্রের হয়ে এ কাজে সহযোগিতা করছেন। তদন্তে এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

চক্রটি যেভাবে কাজ করে

মাহবুবা ও মাহমুদুলের নেতৃত্বে প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই চক্রের সদস্যরা চারটি দলে ভাগ হয়ে কাজ করতেন বলে জানান ডিবির কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিস্তৃত এই চক্রের নেটওয়ার্ক। মূলত চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহের কাজ করতেন চক্রের মাহবুবা নাসরিন ও রাজ আহমেদ (তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে)। চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে টাকার বিষয়টি চূড়ান্ত হলে চক্রের আরেক হোতা মাহমুদুলের কাছে পাঠানো হতো। মাহমুদুল প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য চীন থেকে বিশেষ ধরনের ‘ডিজিটাল ডিভাইস’ সংগ্রহ করতেন। পরে ডিভাইসগুলো নোমান সিদ্দিকীর (গ্রেপ্তার করা হয়েছে) মাধ্যমে পরীক্ষার কয়েক ঘণ্টা আগে চাকরিপ্রার্থীদের বুঝিয়ে দেওয়া হতো।

ডিবি সূত্র জানায়, পরীক্ষার্থী সেজে কেন্দ্রে ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে প্রবেশ করতেন চক্রের দুই সদস্য আল আমিন, নাহিদ হাসান (দুজনই এখন গ্রেপ্তার)। তাঁরা পরীক্ষার হল থেকে ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্ন বাইরে পাঠাতেন। বাইরে থাকা চক্রের অন্য সদস্যরা দ্রুত প্রশ্ন সমাধান করে ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের কাছে পাঠাতেন।

এদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার ঘটনায় মাহবুবা নাসরিনের নাম আসার বিষয়ে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মাহবুবা জেলা আওয়ামী লীগ এবং দুপচাঁচিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।