রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও একজন শিক্ষককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল শনিবার সকালে ক্লাস নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে শহরের শালবাগান এলাকায় হামলার শিকার হন ইংরেজির অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী (৫৮)। গত এক যুগে এ নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন অধ্যাপক খুন হলেন।
পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে এই হত্যাকাণ্ডের কোনো কারণ জানাতে পারেনি। তবে হত্যাকাণ্ডের ধরন দেখে বলছে, অন্যান্য ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের হত্যার সঙ্গে এই হত্যার মিল রয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জঙ্গি তৎপরতা নজরদারির ওয়েবসাইট ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ’ গতকাল এক টুইটার বার্তায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) পরিচালিত আমাক নিউজ এজেন্সির বরাতে জানিয়েছে, অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যার দায় স্বীকার করেছে আইএস। টুইটার বার্তায় বলা হয়, ‘নাস্তিকতার দিকে আহ্বান জানানোর’ দায়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অধ্যাপককে হত্যা করেছে আইএস। তবে এর আগে সর্বশেষ অধ্যাপক শফিউল ইসলাম হত্যার দায় স্বীকার করেছিল আনসার আল ইসলাম (আনসারুল্লা বাংলা টিমের নতুন নাম)।
রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ সামসুদ্দিন জানিয়েছেন, বোয়ালিয়া থানার শালবাগান এলাকার নিজ বাসায় পরিবার নিয়ে থাকতেন অধ্যাপক রেজাউল। কাল সকালে বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছিলেন তিনি। পথে তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, সারা দেশে ব্লগার হত্যার ধরনের সঙ্গে এই হত্যার মিল রয়েছে। এ থেকে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের হাতে তিনি খুন হয়েছেন।
নিহত অধ্যাপকের ভাই সিরাজুল করিম সিদ্দিকী নাটোরের সিংড়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, রেজাউল করিম বাসার দ্বিতীয় তলায় থাকতেন। বাসা থেকে রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়ক দু-তিন মিনিটের হাঁটা পথ। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া জন্য তিনি মহাসড়কের কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন। মহাসড়কের আগে একটি গলিপথে তাঁকে হত্যা করা হয়।
ঘটনাস্থলে একটি বাসার সামনে অধ্যাপক রেজাউলের লাশ উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। পেছন থেকে তাঁর ঘাড়ে কোপ দেওয়া হয়েছে। আঘাত তাঁর কান হয়ে মুখ পর্যন্ত নেমে এসেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার ও সুন্দরম নামের একটি আবৃত্তি সংগঠনের পরিচালক হাসান রাজা বলেন, হামলার খবর শোনার পরপর তিনি ছুটে যান ঘটনাস্থলে। একজন গৃহকর্মী একটি বাচ্চা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলেন। তিনি হাসান রাজাকে বলেছেন, দুজন যুবককে একটি মোটরসাইকেলে গলি পার হয়ে যেতে দেখেছেন তিনি। এরপরই চিৎকার ও কান্নার আওয়াজ শুনতে পান।
অধ্যাপক রেজাউলের সহকর্মীরা জানিয়েছেন, তিনি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি ‘কোমলগান্ধার’ নামে নিজের প্রতিষ্ঠিত একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর লেখায় বা বক্তব্যে কখনো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার কোনো নজির পাওয়া যায়নি।
তাঁর সহকর্মী অধ্যাপক শহীদুল্লাহ বিবিসিকে বলেন, একজন সহকর্মী তাঁকে আজই জানিয়েছেন যে কয়েক দিন আগে কয়েকজন শিক্ষকের কাছে উড়ো চিঠি পাঠানো হয়েছিল এই বলে যে ‘বিভাগের কোনো কোনো শিক্ষক ক্লাসে নাস্তিকের মতো কথাবার্তা বলেন’। তবে চিঠিতে কোনো শিক্ষকের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বেলা দেড়টার দিকে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিকেল সোয়া চারটার দিকে শালবাগান সিঅ্যান্ডবি মাঠে তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বাদ আসর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় জানাজা হয়। বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জ পৌর এলাকার দরগামাড়িয়া মহল্লায় তৃতীয় জানাজা শেষে সন্ধ্যায় পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
নিহত অধ্যাপকের ছেলে রিয়াসাত ইমতিয়াজ বাদী হয়ে গতকাল দুপুরে বোয়ালিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। মামলাটি তদারকির জন্য রাজশাহী নগরের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, উপকমিশনার (পশ্চিম), সহকারী কমিশনার (বোয়ালিয়া জোন), মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার ও বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে।
অধ্যাপক রেজাউল ১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ২০০৬ সালে অধ্যাপক পদে তাঁর পদোন্নতি হয়। তাঁর দুই সন্তান। মেয়ে রিজওয়ানা হাসিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করেছেন। ছেলে রিয়াসাত ইমতিয়াজ রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) পুরকৌশল স্নাতক বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।
সংস্কৃতিমনা ছিলেন রেজাউল: অধ্যাপক রেজাউল সেতার বাজাতেন। গতকাল বাসায় তাঁর শোয়ার ঘরে গিয়ে দেখা যায়, বিছানার ওপরে তার প্রিয় সেতারটা রাখা। সেতারের ‘কেইস’টা মেঝেতে। দেখে মনে হচ্ছে, হয়তো রাতেই সেতার বাজিয়েছেন।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোমলগান্ধার নামের সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্য নাঈম ইমতিয়াজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তিনি বলেন, স্যার শহীদুল্লাহ কলাভবনের ২২৭ নম্বর কক্ষটি সাংস্কৃতিক কাজের জন্য ব্যবহার করতেন। অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরাও সেটা ব্যবহার করতেন। সংগঠনের পক্ষ থেকে কোমলগান্ধার নামে একটি ছোটকাগজ বের করতেন স্যার। এবার ষষ্ঠ সংখ্যা বের হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরাই লিখতেন। স্যার লিখতেন সম্পাদকীয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, অধ্যাপক রেজাউল হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে ইংরেজি বিভাগ আজ রোববার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। গতকাল বিকেলে ইংরেজি বিভাগের একাডেমিক কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অন্য বিভাগগুলোকেও একই কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানানো হয়েছে বিভাগের পক্ষ থেকে। এই তিন দিন সকাল ১০টায় সিনেট ভবনের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি গতকাল দুপুর ১২টা থেকে ক্লাস বর্জন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আজ রোববারও ক্লাস বর্জন কর্মসূচি চলবে। এ ছাড়া সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র ধর্মঘট পালনের ডাক দিয়েছেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
গতকাল দিনভর প্রতিবাদমুখর ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে সকাল সোয়া ১০টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টা ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে ১১টায় ক্যাম্পাসের শহীদুল্লাহ কলাভবনের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রগতিশীল ছাত্রজোট। দুপুর পৌনে ১২টায় ইংরেজি বিভাগের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন বিভাগের তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। সোয়া ১২টায় সিনেট ভবনের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।
সমাবেশে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন অধ্যাপক রেজাউল করিম। তিনি বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যেন বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। এখানে একের পর এক শিক্ষক হত্যার ঘটনা ঘটছে। আমরা আর কোনো হত্যা দেখতে চাই না।’
পরীক্ষা ও ক্লাস বর্জন: অধ্যাপক রেজাউল হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি গতকাল সন্ধ্যা সাতটায় জরুরি বৈঠকে বসে। বৈঠক শেষে রাত ১১টার দিকে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শাহ আজম শান্তুনু সাংবাদিকদের বলেন, আজ রোববার ও আগামীকাল সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষাসহ সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে তাঁরা বিরত থাকবেন। এই দুই দিন শিক্ষকেরা মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ এবং উপাচার্যের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করবেন। পরবর্তী সময়ে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
বাগমারা (রাজশাহী) প্রতিনিধি জানান, অধ্যাপক রেজাউল করিমের গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জ পৌরসভার দরগামাড়িয়া গ্রামে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। তাঁর চাচাতো বোন স্থানীয় দরগামাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহানারা বেগম বলেন, রেজাউল করিম প্রায়ই গ্রামে আসতেন। এলাকায় ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন ফোকলোর সম্পর্কে তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করতেন এবং ভিডিও ধারণ করতেন।
অধ্যাপক রেজাউল এলাকার শিশু-কিশোরদের জন্য গানের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। ওই সংগীত বিদ্যালয়ের সভাপতি রাজু আহমেদ জানান, একজন সংগীতশিক্ষক রেখে এলাকার শিশু-কিশোরদের গান শেখাতেন অধ্যাপক রেজাউল। সব খরচ তিনিই বহন করতেন।
নিন্দা ও প্রতিবাদ: অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যাকাণ্ডের নিন্দা, প্রতিবাদ ও অবিলম্বে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, অতীতের হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হওয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো তাদের হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।
শরীফ নূরুল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এক বিবৃতিতে অবিলম্বে দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার ও বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছে। একই দাবিতে বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী বলেছে, এ ধরনের কোনো হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার না হওয়ায় খুনি চক্র তাদের হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।
নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও।
আরও পড়ুন: