গুমবিষয়ক জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ওয়ার্কিং গ্রুপের ১২৫তম অধিবেশন শেষে হালানাগাদ প্রতিবেদন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বলেছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশানা করতে গুমকে অব্যাহতভাবে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে। গুমের এসব অভিযোগের বিষয়ে তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে।
বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও গুম-খুনের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং তাঁদের ও সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাতের ভিত্তিতে ওই পর্যালোচনার কাজ সম্পন্ন করে ওয়ার্কিং গ্রুপ।
গুমবিষয়ক জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ওয়ার্কিং গ্রুপের ১২৫তম অধিবেশন শেষে তৈরি করা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গুম পরিস্থিতি নিয়ে এসব কথা বলা হয়েছে।
গত ২০ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর ওয়ার্কিং গ্রুপের ওই বৈঠক হয়। ৬ ডিসেম্বর এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন হালনাগাদ করেছে ওয়ার্কিং গ্রুপ। এখন পর্যন্ত গুমের ঘটনা ঘটেছে এমন দেশগুলোকে এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। গুমের অভিযোগ খতিয়ে দেখা এবং এ নিয়ে পরামর্শসহ ওয়ার্কিং গ্রুপের বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রসঙ্গও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
জেনেভায় বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের একটি সূত্র গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে জানিয়েছে, সাধারণত ওয়ার্কিং গ্রুপ রুদ্ধদ্বার আলোচনা করে থাকে। তবে তাদের কাজের পরিধির মধ্যে বাংলাদেশের প্রসঙ্গটি থাকায় ৬ ডিসেম্বর যে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করেছিল, তা তারা বাংলাদেশ মিশনকে জানিয়েছে। জেনেভা মিশন পরে ওই প্রতিবেদন ঢাকায় পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছে।
ওয়ার্কিং গ্রুপের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সরকার বা রাজনৈতিক বিরোধিতার বিরুদ্ধে যেকোনো সমালোচনা প্রতিরোধে গুমকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সে অনুযায়ী, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে গুমসহ ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়ে যায়।
ওয়ার্কিং গ্রুপ এ বছর তিনটি অধিবেশনে বিভিন্ন দেশে সংঘটিত নতুন-পুরোনো গুমের ঘটনা এবং এ–সংক্রান্ত পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করেছে। এর বাইরে সাধারণ অন্যান্য অভিযোগও পর্যালোচনা করেছে তারা। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও গুম-খুনের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং তাঁদের ও সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাতের ভিত্তিতে ওই পর্যালোচনার কাজ সম্পন্ন করে ওয়ার্কিং গ্রুপ।
৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ২২ মে থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে গুমের ১৩টি অভিযোগকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের একটি ঘটনা রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জরুরি পদক্ষেপের অংশ হিসেবে গত ৬ জুলাই র্যাবের হাতে মো. মাহমুদ হাসান ওরফে মুফতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান গুনবির অপহরণের প্রসঙ্গটি সরকারকে জানানো হয়েছে।
তবে ঢাকায় গত ১৬ জুলাই র্যাব সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিল, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের ‘আধ্যাত্মিক নেতা’ মাহমুদুল হাসান গুনবিকে আগের রাতে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি সংসদ ভবনে হামলা পরিকল্পনার অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা একটি মামলার আসামি বলে তখন জানানো হয়েছিল।
* গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রতিবেদন ৬ ডিসেম্বর হালনাগাদ করা হয়েছে। * ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে গুমসহ ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়ে যায়।
গুমের শিকার হওয়া থেকে প্রত্যেক ব্যক্তির সুরক্ষাসংক্রান্ত ঘোষণার (ডিক্লারেশন অন দ্য প্রটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স) লঙ্ঘন এবং এ ঘোষণা বাস্তবায়নে বাংলাদেশে বাধা দেওয়ার অভিযোগ বিষয়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য পেয়েছে ওয়ার্কিং গ্রুপ।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন সময় বাংলাদেশকে অভিযোগ জানিয়েছে এবং ওয়ার্কিং গ্রুপ এ বিষয়ে বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিল। এ বিষয়ে ২০১৩ সালের ১২ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত তাদের কোনো জবাব দেওয়া হয়নি, যা আরও বেশি অস্বস্তির। ওয়ার্কিং গ্রুপ বলেছে, মনে রাখা দরকার, যত অভিযোগ পাওয়া গেছে, এর সবই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এসব সংস্থা ও বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা অন্য ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশানা করার জন্য বারবার ও অব্যাহতভাবে গুমকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের গুমসংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ বলেছে, বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ৬০০ জনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুম করেছে। সূত্রগুলো এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে বাংলাদেশ পুলিশের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সক্রিয়ভাবে জড়িত।
ওয়ার্কিং গ্রুপের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সরকার বা রাজনৈতিক বিরোধিতার বিরুদ্ধে যেকোনো সমালোচনা প্রতিরোধে গুমকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সে অনুযায়ী, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে গুমসহ ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়ে যায়।
বিরোধী লোকজনের ওপর উল্লিখিত দমনমূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে গুম করার জন্য কীভাবে নজরদারি (শারীরিক নজরদারি; সেই সঙ্গে টেলিফোনে আড়ি পাতা; আন্তর্জাতিক মোবাইল গ্রাহক পরিচয়-শনাক্তকরণ, অবস্থানভিত্তিক সামাজিক নেটওয়ার্ক মনিটরিং সিস্টেম সফটওয়্যার ও ওয়াই–ফাই ইন্টারসেপ্টরের মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যম ট্র্যাকিং) চালানো হয়, তা জানিয়েছে সূত্রগুলো। নজরদারির কৌশলগুলো করোনা মহামারির সময় বেড়েছে বলে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের নিশানা করা হয়, যারা কোভিড-১৯ মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকারের সমালোচনামুখর হয়েছে।